- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

প্রত্ন উৎখননে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় কঙ্কনদিঘীতে বৌদ্ধ স্থাপত্যের অবশেষ

 সঞ্জয় ঘোষ, জয়নগর, ১৬ জুন#

খননের ছবি প্রতিবেদকের তোলা। ১০ মে।
খননের ছবি প্রতিবেদকের তোলা। ১০ মে।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার রায়দীঘী থানার কঙ্কনদীঘি গ্রামের মাঝিপাড়ায় মঠবাড়ি ঢিবিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ গত ২ মে ২০১৫ থেকে দিন পনেরো উৎখনন চালান। এই উৎখনন পরিচালনা করেন, অধ্যাপিকা দূর্গা বসু। এই উৎখননের সহ পরিচালিকা অধ্যাপিকা মুনমুন মণ্ডল এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে জানান, –‘যেহেতু এই প্রত্ন স্থলটির নাম মঠবাড়ি। তাই আমাদের উৎখননে পাওয়া প্রাচীন ইটের নবম দশম শতাব্দীর মেঝেটি কোনো বৌদ্ধ স্থাপত্যের অংশ হতে পারে। কিন্তু আমরা উৎখননের মাধ্যমে কোনো বৌদ্ধ প্রত্নবস্তুর নিদর্শন পাইনি বলে সরকারিভাবে এদিকে বৌদ্ধ স্থাপত্যের অংশ বলে স্বীকার করতে পারছি না।’ লাল কালো মৃৎপাত্রের (DRW) ভগ্ন অংশ পাওয়াকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে সে প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, –‘আমরা এখানে মাত্র একটি দুটি ছোটো লাল কালো মৃৎপাত্রের ভগ্ন অংশ পেয়েছি। সত্তর আশিটি পেলে তবে বলতে পারতাম, এগুলি তাম্রাশ্ম যুগের (chalcolithic age) লাল কালো মৃৎপাত্র। তাই বলা যায়, তাম্রাশ্ম যুগের ধারাবাহিকতায় (continuation) পরবর্তী যুগের মৃৎপাত্রের ভগ্ন অংশ এগুলি।’ এগুলি কোন সময়ের হতে পারে, এ প্রশ্নের উত্তর তিনি প্রথমে দিতে চাইছিলেন না। পরে জোরাজুরি করায় প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর বলে মন্তব্য করেন।
উল্লেখযোগ্য, গত বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে কঙ্কনদীঘিরই পিলখানা ঢিবি নামে অন্য একটি ঢিবিতে উৎখননে একটি বিশাল বৌদ্ধ স্থাপত্যের কাঠামো উন্মোচিত হয়। বৌদ্ধ তান্ত্রিক তথা বজ্রযান ঘরানার চম্বল নামে ধনের দেবতার মূর্তিও পাওয়া যায়। এগুলি নবম দশম শতাব্দীর বলে জানানো হয়েছিল উৎখননে নেতৃত্বদানকারী প্রত্নতত্ত্ববিভাগের তৎকালীন প্রধান অধ্যাপিকা দূর্গা বসুর পক্ষ থেকে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ববিভাগের প্রধান সম্প্রতি পুরুলিয়ায় বিয়াল্লিশ হাজার বছর আগেকার মানব বসবাসের নিদর্শন পাথরের হাতিয়ার আবিষ্কারক বিষ্ণুপ্রিয়া বসাক। আশা করব, পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসকে যিনি বাইশ হাজার বছর পিছিয়ে দিয়েছেন, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ইতিহাস তাঁর আমলে অনেক পিছিয়ে যাবার গৌরব অর্জন করতে পারবে।
কঙ্কনদীঘির এই উৎখনন স্থলগুলির গুরুত্ব ও উৎখননের প্রয়োজনীয়তা যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে বারে বারে তুলে ধরেছেন, ও এই খননের সঙ্গে যিনি প্রথম থেকে গভীরভাবে জড়িত, তিনি সুন্দরবন প্রত্ন গবেষণা কেন্দ্র, কাশিনগর-এর পরিচালক প্রত্নগবেষক ও সংগ্রাহক দেবীশঙ্কর মিদ্যা। শ্রী মিদ্যা এক সাক্ষাৎকারে জানান, এবারের উৎখননে দুটি প্রাচীন ইটের মেঝে পাওয়া গেছে। প্রথমটি ওপরের দিকে নবম দশক শতকের পাল যুগের বজ্রযান বৌদ্ধ স্থাপত্যের অংশ বলে মনে হয়। দ্বিতীয়টি আরো নিচে কুশান যুগে দ্বিতীয় তৃতীয় শতাব্দীর ধ্রুপদী বৌদ্ধ স্থাপত্যের অংশ বলে মনে হয়। এরও নিচের স্তরে লাল কালো মৃৎপাত্রের ভগ্ন অংশ আবিষ্কৃত হওয়ায় তাঁর মতে ওই স্তরের সময়কাল আজ থেকে দু-হাজার থেকে তিন-হাজার বছরের আগের মধ্যবর্তী কোনো সময়ের। তিনি আরো জানান, এই উৎখননের অনেক আগে, বিভিন্ন সংগ্রাহক ও গবেষক এই ঢিবি থেকে বজ্রযান তথা তান্ত্রিক বৌদ্ধ ঘরানার মারিচী দেবীর মূর্তি সহ নানান মূর্তি সংগ্রহ করেছেন। তাই এই বিশাল ঢিবিটি বৌদ্ধ বিহার হওয়ার সম্ভবনা যথেষ্ট। প্রত্নদ্রব্য পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য, ঐতিহাসিক প্রত্নস্থলগুলির ওপরে বসবাস, চাষবাস, বাড়িঘর নির্মাণ সহ নানা অনৈতিহাসিক কার্যকলাপ ও স্থানীয় মানুষের এ বিষয়ে নিজেদের ইতিহাস অসচেতনতা ও অবহেলার ফলে প্রত্নস্থলগুলি ও সুন্দরবনের গৌরবময় বিস্ময়কর ইতিহাস লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বলে তিনি আক্ষেপ করেন। স্থানীয় মানুষের একাংশের অসহযোগিতার ফলে এই বিশাল প্রত্নস্থলটির ছোট্ট একটি অংশে মাত্র উৎখনন করা গেল এবছর। তিনি আক্ষেপ করেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎখননের দলটি ধীরগতিতে উৎখনন ও আরো গভীরে উৎখনন না করে কাজ বন্ধ করে দেওয়ায় তাম্রাশ্ম যুগে সুন্দরবনে মানুষের বসবাস ছিল কি না তা জানা গেল না। যদিও তিনি সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে অস্বীকৃত তাম্রাশ্ম যুগের নিদর্শন পেয়েছেন।