- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

পুড়ে যাওয়া মহেশতলা ষোলোবিঘা বস্তির আত্মকথা

এখানে মানুষ বাস করে? তোমাদের আর এইভাবে বসবাস করতে হবে না। তোমাদের ফ্ল্যাটবাড়ি করে দেব। ৫৪০০০ করে টাকা দিতে হবে।
দুলাল দাস, পুরসভার চেয়ারম্যান

দুলু খান, ২৭ নভেম্বর#

পঁচিশ থেকে ত্রিশ বছর এই বস্তি হয়েছে। আমি আছি আজ পনেরো বছর। আমরা ছিলাম কামারহাটিতে। ওখানে একটা গণ্ডগোল ছিল। তার মাধ্যমে আমরা পীরডাঙ্গার কাছে বড়ো জলার পাশে কানখুলিতে এসে ঘরভাড়ায় থাকি। ভাড়ার ঘরে আর কতদিন থাকা যায়। ওখানে এসে যখন বসবাস করছি, অনেক লোকের সঙ্গে আমার স্বামীর যোগাযোগ হল। তিনি পাতকুয়ার কাজ করতেন। লোকে বলল, ভাড়ার ঘরে আর থাকবি কেন, ষোলোবিঘায় জায়গা পাওয়া যায়, একটু জায়গা নিয়ে ঘর করে বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করবি। ভালো। আমরা সেখান থেকে এখানে এসে একটা ঘর দেখলাম। ঘরটা পড়া। ঘরের মালিক ঘরটা বিক্রি করছে, আট হাজার টাকায় কিনে নিলাম। কানখুলিতে আমার ছেলেমেয়েকে পড়াশুনায় কেউ মদত দেয়নি। এখানে যেদিন এলাম, তার পরেরদিন থেকে আমি ‘রাইট ট্র্যাক’-এর সঙ্গে যুক্ত। আমার তিনজন বাচ্চাকে এরা ভরতি নিয়ে নিল। রাইট ট্র্যাক থেকেই লেখাপড়া শিখিয়ে বাইরের স্কুলে ভরতি করে। রামপুরে অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়ল। তারপর সরকারপোল ডিরোজিও স্কুলে ভরতি করা হয়। তিনটে বাচ্চা ওখানেই পড়াশুনা করে। এখনও ছোটো মেয়ে ওখানেই ক্লাস সেভেনে পড়ছে। একটা পরীক্ষা দেওয়ার পর পড়া নষ্ট হয়ে গেল, দুর্ভাগ্য (বস্তি পুড়ে যাওয়ায়)। আমার স্বামী আজ আট বছর মারা যান। তাঁর গলায় ক্যানসার হয়েছিল। দীর্ঘদিন প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করেও আমি তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। ছেলেমেয়ে ছোটো ছোটো ছিল। এলাকার লোকে চাঁদাপত্র তুলে সাহায্য করেছিল।

পুড়ে যাওয়ার পর, ছবি জিতেন নন্দী

আমার আর্থিক অবস্থা কিছুই নেই। যতক্ষণ খাটা, ততক্ষণ খাওয়া। স্বামী মারা যাওয়ার পরে আমি মোল্লারগেটে সার্ফ (সাবান) কারখানায় কাজ করি। একশো সাবান প্যাকেট করা গেলে সত্তর টাকা পাওয়া যায়। এইভাবে কাজ করে বাচ্চাদের নিয়ে আমি সংসার চালাই। তারপরে দেখছি, ওখানে খুব খাটুনি, আমার খুব কষ্ট হয়। ওখান থেকে বার হয়ে এসে আমি হাজিরতনে ওস্তাগরের বাড়ি বাসন ধোয়ার কাজ করি। কিছুদিন জোগাড়ের কাজও করেছি, দেখছি ব্যবহার খারাপ। আমি আর সেখানে করলাম না।

এর মধ্যে আমার ছেলে একটু হাত ধরার মতো হয়ে গেছে। জুম্মান আলি খান, আমার ছেলে, ওর বয়স এখন পঁচিশ। ও এখন রিকশা চালায়। তারপর ওইসব কাজ ছেড়ে দিয়ে আমি রাইট ট্র্যাকের সঙ্গে সব জায়গায় যাওয়াআসা করি। আমি একটা সার্কেলও চালাই। যে সমস্ত বাচ্চারা ইস্কুলে যায় না, তাদের মায়েদের নিয়ে বসে বোঝাই। যেসব মহিলারা নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের ব্যাপারেও ঝাঁপিয়ে পড়ি। তাদের সমস্যা সমাধান করার কাজ করি। আমাদের একটা ফেসিলিটি ছিল, ছশো করে টাকা পেতাম। আপাতত সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। তাহলে আমার কী করে চলবে? এবারে রাইট ট্র্যাক পাল্‌স পোলিও কাজটা নিয়েছে, তাতে আমি ভলান্টিয়ারের কাজ করি। আগে এতে ১৪০০-১৫০০ করে টাকা পেতাম। এখন কাজও কম, টাকাও কম। এতে আমার চলা অসম্ভব।

ইতিমধ্যে এই পুরসভার চেয়ারম্যান দুলাল দাস একদিন সকালে এখানে এলেন। আমি তখন চান করছি, ডিউটি যাব বলে। খবরটা শুনতে পেয়ে দৌড়ে ওই ভিজে কাপড়ে বার হলাম। উনি ঘুরে দেখে বলছেন, ‘ইস্‌ অদ্ভুত! এখানে মানুষ বাস করে? এরা গরু-ছাগলের মতো বাস করছে। তোমাদের আর এইভাবে বসবাস করতে হবে না। তোমাদের ফ্ল্যাটবাড়ি করে দেব। ৫৪০০০ করে টাকা দিতে হবে।’ মানুষ শুনল। লোকের দুয়ারে দুয়ারে হাঁটছেন আর এইভাবে বলছেন। এখানে একগলা পর্যন্ত জল ছিল একসময়। তখন কিন্তু এই চেয়ারম্যান ঢোকেনওনি, দেখেনওনি। এইসব গরিব মানুষের টাকা আর রাইট ট্র্যাকের পয়সায় রাস্তা আর ডাঙা করা হয়েছে। এখন চেয়ারম্যানের চোখ পড়ে গেছে। কীভাবে ফ্ল্যাট পাব? সবাই কি পাব? উনি তখন বলছেন, ‘এখানকার ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড যার আছে, সে পাবে।’ আরে বাপ! রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড আমরা কোথায় পাব? তোমরা তো করে দাওনি। বারবার অ্যাপ্লাই করেছি। তাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া … একটা বাচ্চা জন্মাবার পরে যে জন্ম-সার্টিফিকেট সেও তোমরা করে দাওনি। তাহলে এই জায়গায় আমাদের ফ্ল্যাট দেবেন উনি আর আমরা বাস করব? আমরা মানতে পারছি না।

তার মধ্যে সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখে দুলাল দাস এসে শিলান্যাস করে যান। ওই মাথার দিকে একটা খালি জায়গা আছে, ওখানে উনি শিলান্যাস করেন। ওনার সঙ্গে ডিএম-ও ছিলেন। ডিএম কিন্তু ওনাকে বলেছেন, ‘দেখুন এখানে কিন্তু গরিব মানুষেরা বসবাস করে, এদের যাতে ক্ষতি না হয়।’ ওরা মহেশতলার পুরো এরিয়ার মধ্যে ৮৮৪টা ফ্ল্যাট দেবে, ১১নং ওয়ার্ডে ৩৫টা দেবে। তাও বাজারপাড়ার পোল থেকে ষোলোবিঘা পর্যন্ত। যার রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড আছে তাকে দেবে। অধিকাংশ মানুষের তো কিছুই নেই। আমরা তো অত বোকা নয়। অন্যান্য এলাকা থেকে মানুষ এনে এখানে বসাবে।

ওখানে আমরা মিটিং শুনতে গেলাম। শুনে আমরা বলছি, আমাদের তো আর এখানে রাখবে না। আমাদের তুলেই দেবে। তাহলে এইবার আমরা আমাদের আন্দোলন শুরুই করি। দেখা যাচ্ছে, এখানকার পুরুষেরা এগোতে পারছে না। তখন আমরা ২০ সেপ্টেম্বর একটা দল করলাম, মহিলা সমিতি। এখন তো মেয়েদেরই সব জায়গায় এগোতে হয়। চলো আমরাই এগোই। আমাদের পুরুষদের ডেকে নিয়ে বললাম। তখন ওরা বলল, তোমরাই এগোও, আমরাও তোমাদের মদত দিতে পেছনে আছি। মহিলা সমিতির সদস্য হয়েছে ৪৭২ জন। আমরা কাজ করতে শুরু করলাম। যেখানে যেখানে কাগজ আর রিপোর্ট দেওয়ার সমস্ত জায়গায় দেওয়া হয়েছে। ডিএম-কে, মুখ্যমন্ত্রীকে, সর্ব জায়গায় আমরা দিয়েছি। এআইইউডিএফ-এর রাজ্য সভাপতি এখানে এসে মিটিং করেন।

২১ নভেম্বর আমাদের একটা বড়ো জনসমাবেশ হওয়ার কথা ছিল। দুলাল দাসের নেত্রীগণ আমাদের হুমকি দেন, ২০ তারিখের মধ্যে মাঠ করে দেব। এমনকী খুনের হুমকিও দেন। আমরা কিন্তু আমাদের আন্দোলন করে যাচ্ছি। ২১ তারিখ আমাদের প্রোগ্রাম হবে, তার আগের দিন ২০ তারিখ আমি পোলিওর ডিউটি থেকে এসেছি। আমি বাড়িতে গিয়ে সবে দুটো ভাত নিয়ে বসেছি। রফিক মোল্লা প্রশাসন নিয়ে ঢুকেছে। কী একটা ঘুরিয়ে দেখালেন তিনি। প্রশাসনের সঙ্গে আমার এলাকার ‘বস্তি বাঁচাও কমিটি’র সেক্রেটারি সউদ শেখ ছিলেন। আগুন লেগে গেছে শুনে আমাদের ছেলেরা দৌড়ে যাচ্ছে, পুলিশ তাদের ধরে নিচ্ছে, বলছে, ‘যেও না, মরে যাবে’। ছেলেরা বলেছে, ‘আরে, আমার বস্তি পুড়ে যাবে, আমার মা-চাচীরা সব মরে যাবে আর আমরা এখানে দাঁড়িয়ে থাকব? আপনি এক্ষুনি ফায়ার ব্রিগেডকে ডাকুন, ফোন করুন। আমার মা-চাচী আর ছোটো ছোটো বালবাচ্চাকে বাঁচান।’ কিন্তু ওরা ছেলেদের এগোতে দিচ্ছে না। ইদ্রিস মোল্লাকে পুলিশ ধরে রেখেছে। এরপরে পুলিশ চলে গেল।

এমন আগুন আমি জীবনে কোথাও দেখিনি। মনে হয় আগুন আমাকে খাচ্ছে। আগুন লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। সেই দৃশ্য! এখনও পর্যন্ত সেদিন আগুন জ্বলছে। পৌনে একটার সময় আগুন লাগায়। আমি একগাল ভাত মুখে দিয়েছি। বাইরে বেরিয়ে আগুন দেখেই দৌড়ে ঘরে ঢুকে আমি শুধু ফোনটা নিয়েছি, আর কিছু নিতে পারিনি। আমার ঘরে মেয়ের বিয়ে দেব বলে টাকা ছিল। কানের রিং করেছি তিনমাস হল। জামাইকে দেওয়ার জন্য আংটি করেছি। আমার ছেলে ব্যাঙ্কের বই করেছে। আমার কাছে এমএনজিএম-এর অ্যাকাউন্ট বই ছিল। আমার অফিসিয়াল কাগজপত্র ছিল। আমি কিছুই বার করতে পারিনি। কাপড়চোপড় তো দূরের কথা। আমি নেমে যাই পুকুরে। পুকুর সাঁতরে আমি ওইদিকে গিয়ে উঠেছি। ছোটো মেয়ে ইস্কুলে ছিল। শুনলাম, কী একটা কেমিকাল ছড়িয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে রফিক মোল্লা পালিয়ে গেল। এইভাবে আগুন লাগিয়ে গেল। সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। আমার পাশের ঘরের এক দাদা, মনিরুল পাইক। বাচ্চাদের বার করতে গিয়ে তাঁর কান থেকে ওপরের একটা অংশ পুড়ে গেছে। তাঁর পাশের ঘরের একটা চার বছরের বাচ্চা ইমরাজ গায়েন পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। পুলিশ কাউকে না ঢুকতে দিয়ে লুকিয়ে ওই বাচ্চাকে নিয়ে গাড়িতে করে চলে যায়।

এখন নানান দিক থেকে নানান সমস্যা। বাচ্চাদের নিয়ে ত্রিপলের তলায় থাকা, রাতেরবেলায় শিশির টপ টপ করে মাথায় পড়ছে। আমার নিজের শরীরও খারাপ। ডিএম কিছু চাল-টাল পাঠিয়েছিলেন। কিছু ত্রিপল, কম্বল দেওয়া হয়েছে। এখন নানান জায়গা থেকে সাহায্য আসছে। ‘নাগরিক রক্ষা কমিটি’র সভাপতি ও সেক্রেটারি এবং মহিলা কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারি যৌথভাবে বিতরণের কাজ করছে। এআইইউডিএফ-এর নেতা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি চাপ দিয়েছেন পুলিশ প্রশাসনের ওপর। এখন রাতেরবেলায় পুলিশ পাহারায় থাকছে। বস্তির ভিতরে রফিকের চুল্লুর ঠেকে ক্যাম্প করা হয়েছে।

রফিক এখানে চুল্লু, মদ, গাঁজা, মেয়ে পাচার করে। ওদের বংশটাই দীর্ঘদিন এই করে আসছে। আগে সিপিএম করত। এখন দুলাল দাসের দল করে। শুনেছি, ষোলোবিঘাকে পুরো মাঠ করে দেওয়ার কনট্রাক্ট ছিল। প্রশাসন ওদের অ্যারেস্ট করেনি। রফিক সেইসময়ই পালিয়েছে। ওর ভাগনাও পালিয়েছে। নিতাই হালদারও পালিয়েছে। তাহের মিস্ত্রি, হাঁসা আরও আছে। এরা কেউই এখানে নেই।