- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘পাশে দাঁড়ান, আমাদের বোঝার চেষ্টা করুন’

তোজাম্মেল ও বঙ্কিম, কলকাতা, ১৪ জানুয়ারি#

দ্বারভাঙা হলে ১০ জানুয়ারি বলছেন একজন মহিলা। ছবি আফরোজা খাতুন-এর ফেসবুক পৃষ্ঠা থেকে পাওয়া।
দ্বারভাঙা হলে ১০ জানুয়ারি বলছেন একজন মহিলা। ছবি আফরোজা খাতুন-এর ফেসবুক পৃষ্ঠা থেকে পাওয়া।

১০ জানুয়ারি ২০১৫ শনিবার দুপুর বারোটায়  ‘মুসলিম মহিলাদের জন্য আইনি সুরক্ষা’ একটা আলোচনা হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙা হলে। সাউথ ক্যালকাটা সোসাইটি ফর এম্পাওয়ারমেন্ট অফ উওমেন-এর উদ্যোগে এই আলোচনায় রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের নারীরা যেসব কথা বলেছে তার কিছুটা তুলে ধরা হল :

শরিফা বিবি

আমি মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে এসেছি। বিয়ের পর আমাকে এমনভাবে নির্যাতন করেছে যে পরপর আটটা বিয়ে করেছে। এবার আমার একটা বাচ্চা ক্লাস টেনে পড়ছে। আমি কী করে খাওয়াব পড়াব, পোশাক দেব। এই যে একের পর এক বিয়ে করেই যাচ্ছে, এর কি কিছু করা যাবে না? আপনারা সবাই মিলে যাতে এটা বন্ধ করা যায়, তালাক দেওয়া বন্ধ করা যায়, আপনাদের সবার কাছে আবেদন রাখছি।

রূপালি খাতুন

নদিয়া থেকে আমি এসেছি। আমরা চার বোন। আমার বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি, তখন আমার বিয়ে হয়ে গেছিল। বিয়ের পর যে সমস্যাটা হল যে আমি দেখতে সুন্দর নই। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সে বলল যে, আমি দেখতে সুন্দর নই, তাই আমাকে নিয়ে ঘর করতে পারবে না। ‘তোমাকে তালাক দিয়ে দেব’। সবাই আমাকে বোঝাতে লাগল যে, তোর চারটে বোন, তালাক হয়ে গেলে আবার বাবা কি করে বিয়ে দেবে। তাই আমি কষ্ট করে থেকে গেলাম। আমি ফাইট করে মানে যুদ্ধ করে থেকে গেলাম। এবং মাধ্যমিক পরীক্ষাটা দিলাম।
তারপর যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল সে বাইরে (কাজে) চলে গেল। তার কাছে আমাকে একজন নিয়ে গেল। সেখানে সে আমাকে এত মারধোর করতে লাগল, যে আমার শরীরের এমন জায়গা নেই যেখানে দাগ নেই। বাড়ি এসে আমাকে তালাক দিয়ে দিল। আমি স্কুলে নতুন করে ভর্তি হলাম। আমাকে পথে ঘাটে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে। যেতে হলেই সবাই আমাকে দেখিয়ে বলে, দ্যাখ্‌ তালাক হওয়া মেয়ে এসেছে। স্কুলে গেলেই অন্যরা বলত, তোর তো তালাক হয়ে গেছে। তুই কেন ইস্কুলে পড়তে আসিস, তুই পড়াশুনো ছেড়ে দে। আমাকে শেষ পর্যন্ত কেউ বেঁচে থাকতেই দিচ্ছে না। কেন জানি না, কেন দিচ্ছে না। আমি যখন মাধ্যমিক পরীক্ষা দিই, খুব টেনশনে ছিলাম। আমি খুব ভালো ছাত্রী ছিলাম। কিন্তু বাড়ির থেকে কোনো সাহায্য করতে পারবে না বলে জানিয়ে দিল। আমি বাবা মা-কে জানিয়ে দিলাম যে আমি টিউশনি করে পড়ব। আমি টিউশনি করি, আর পড়ি। তাই আপনাদের কাছে আবেদন, আপনারা এই তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের পাশে দাঁড়ান।
তালাকের পরে বাড়ি থেকে বলল যে, তোকে আবার বিয়ে দিয়ে দেব। আমি বাড়ির লোকেদের বললাম যে, বিয়ে করে তো দেখলাম কী ফল। তাই আমি বিয়ে করব না। আমি এখনো টিউশনি করি ও পড়ি। তাদের সমস্যা জানুন, এবং তার সমাধানের চেষ্টা করুন। নিচ থেকে যে ওপরে উঠবে, তার উপায় নেই। সমস্ত তালাকপ্রাপ্ত মেয়ের পাশে দাঁড়ান, তাদের বোঝার চেষ্টা করুন, এই আমার আবেদন। (রূপালী কাঁদতে কাঁদতে মাইক্রোফোনের সামনে থেকে সরে গেল)

পাশে দেখলাম, শাকিলার চোখে জল। ওর পাশেই ওর বছর বারোর কন্যাটি তাকিয়ে আছে। সেই ভোররাতে ওরা মা মেয়ে বোলপুর থেকে ট্রেন ধরে কলকাতায় এই আলোচনায় চলে এসেছে। ওর স্বামী আছে কলকাতাতেই, অপর এক মহিলার সাথে ঘর করছে, বলল শাকিলা। শাকিলা এখন গ্রামেই তার মেয়েদের নিয়ে থাকে। আপ্রাণ চেষ্টা করছে মেয়েদুটোকে মানুষ করতে। শাকিলা শিশুশিক্ষা নিয়ে একটা এনজিও-র হয়ে গ্রামে গ্রামে কাজ করে। গত দু-বছর ধরে কোর্টে মামলা চালাচ্ছে শাকিলা। অথচ সন্তানদের জন্য বাবার কাছ থেকে আজও একটাকাও পায়নি। ওর কথাগুলো অন্য সকলের শোনা হল না, কারণ ওকে ফিরে যেতে হবে, সেই বোলপুর থেকে বহুদূরের গ্রাম বাসাপাড়া। সেখানে তার ছোট্ট মেয়েটি তার মায়ের পথ চেয়ে বসে আছে।

ফরিদা খাতুন

নদীয়া থেকে এসেছি। সকলেরই বাবা মা সকলে আছেন। আমি একজন কুলনারী যে বাপ মা-র ঘরে ঠাঁই পেয়েছে, বিয়ে ভাঙার পরে আর বিয়ে দেননি। আমাদের এই গরিবের ঘরে এই ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের নিয়ে যে আমি কীভাবে আছি, তা আপনাদের কাছে জানাচ্ছি। আপনারা একটু দয়া করুন (কান্নায় ভেঙে পড়লেন।) ছোট্টো ছোট্টো বাচ্চাদের স্কুল বন্ধ করে দিয়েছি। মেয়েকে খুব কষ্ট করে পড়াচ্ছি, ছেলেদের খাবার বইপত্র কিনে দিতে পারিনে। ছেলেরা কখনও সামান্য পয়সা চাইলেও দিতে পারছি নে। আমার ধন নেই। বাড়ি নেই। বাপের বাড়িতে থাকি। বাবা মা গরিব। ভাই দু-বেলা মারতে যায়। আমি সহ্য করতে পারি নে। আপনাদের কাছে আমার নমস্কার। আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি, আমাদের জন্য কিছু করুন। আমাদের মতো অসহায় নারীদের জন্য কিছু একটা করে দেবেন, আমাদের নেই কোনো টাকা পয়সা, গয়নাগাটি, আমি যে কী করে দিন কাটাই, তা বলতে পারছি নে। আমি ছেলেদের মুখে খাবার জোগাড় করে দিতে পারলেও নিজের জন্য কিছুই খাবার দিতে পারিনে। আপনাদের অনুরোধ করব, আমার জন্য কিছু করুন।

সুলেখা বেগম

আমি ভগবানগোলা থেকে এসেছি। আমার স্বামী মারা গেছে দশ বছর হলো। আমার তিনটি মেয়ে। আমার শ্বশুরবাড়ীর কাছে আমার দাবি দরবেশ কিছুই নেই। আমার মেয়ে তিনটেকে লিয়ে কোনোরকম রাস্তার কাজ টাজ করে খাই। আমি সব কিছু থেকে বঞ্চিত। আমার কোনো অধিকার নেই, এমনকি ঘরের ছাদের টিনগুলাকেও জোর করে নামিয়ে নিয়েছে। কেন আমাদের অধিকার নাই।

রেহেনা খাতুন

আমার একটা বক্তব্য, আমাদের যা হবার হয়ে গেছে। পরবর্তী নারীদের যাতে এরকম অবহেলা না হয়। এবং উচ্চস্তরের মানুষদের প্রচণ্ডভাবে দেখা দরকার। এবং সাংবাদিকদের দেখা উচিত, ঘরে ঘরে কী ঘটছে না ঘটছে সেটা জানার। আমরা কোনোরকম সুবিধা পাই না। কোনোদিক দিয়ে নয়। এবং মনে হয়, সমাজের কাছে মনে হয় আমরা ভীষণভাবে অবহেলিত। যারা এই অন্যায়টা করছে, তারা কিন্তু সমাজের কাছে মাথা উঁচু করে থাকছে। আর যাদেরকে এই কাজটা করা হয়েছে, তালাক দেওয়া হয়েছে, তারা অন্যায় করছে। আজ আমি কোর্টে কেস করেছিলাম, আমার ভীষণ বিশ্বাস ছিল যে, অন্যায়ের এগেনস্টে লড়াই করলে অবশ্যই জিততে পারব। কিন্তু ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। আমি পরপর চারটে উকিল চেঞ্জ করলাম। আর আমার উকিলদের সব কিনে নেওয়া হল। তারপর লাস্ট কুণাল ঘোষকে বললাম যে, দেখো, আমার হাইকোর্টের উকিল উনাকে রায় দিয়েছে যে রেকর্ডটা সরিয়ে দেওয়া হবে। আমি আমার উকিলকে সাবধান করেছিলাম, যে আমি জানতে পারলাম যে কোনো একজন বলেছিল। তারপর আমার রেকর্ড কোর্ট থেকে হারিয়ে গেল। আমি পুনরায় আবেদন করলাম। তাতে কোনো ফল পেলাম না। তা সেখানে আমরা কী সমাজের কাছে আশা করব। কোনো আশা করবার মতো মানসিকতা নেই। আমি চুপচাপ বসে গেছি অনেক কষ্টে।
যখন আমার পঁয়ত্রিশ বছর বয়স তখন আমার স্বামী, বলতে খারাপ লাগছে, আমার স্বামী ভীষণ নোংরামি করতেন ওনার বড়োবৌদির সঙ্গে। তাঁর বয়স মা তুল্য। তাঁর সঙ্গে ওনার হয়তো … আমার বলা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু অনেক জ্বালায় বলে দিচ্ছি। ওনার বাবাও ছিলেন সেখানে। আমি এর প্রতিবাদ করে গেছি। আমি এর বেশি আর বললাম না। প্রতিবাদ করে গেছি। প্রতিবাদের কোনো ফল করতে পারিনি। অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু আমি বলতে পারছি না। যখন আমাকে ডিভোর্স করল, তখন আমি বললাম, আমি এই ঘর থেকে যাব না, আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমাকে কেটে ফেলে ঘর থেকে বার করতে হবে। বলে ওই ঘরেই আছি। সেই সময় অমল চ্যাটার্জি বলে একজন চেয়ারম্যান ছিলেন, উনি এবং সিপিএম পার্টির অনেক লিডাররা আমাকে সাহায্য করেছিলেন। আমি ওনাদের কাছে আবেদন জানিয়েছিলাম যে আমরা কার কাছে যাব। কোথায় গেলে এর বিচার পাব। ওনারা আমায় সেই সময় হেল্প করেছিলেন কিছুটা। সেই সময় আমার ছেলেমেয়ে। ছোটো ছেলের বয়স সাত বছর, তার ওপরের মেয়ের বয়স আট বছর। বড়ো মেয়ের বয়স তখন ষোলো বছর। মেয়ে আমার স্কুল ফাইনাল পাস করল, আর ওকে ইস্কুলে দেবে না। আমি তখন বললাম, আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। সামান্য পড়াশুনো করে। আমি আমার মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করব। সেইভাবে আমি যতটুকু পেরেছি রাত তিনটে অবধি সেলাই করে, শাড়ি বিক্রি করে ওদের মানুষ করেছি।
কিন্তু আমার দুঃখের বিষয় — যেন সমাজে আমাদের কোনো স্থান নেই। ডিভোর্স হয়ে গেল মানে যেন আমরা ভীষণ অবহেলিত। এইটা যেন কোনো নারীর না হয়। সমাজ যেন এটা খুব ভালোভাবে দেখে। … সরকারের থেকে কিছু করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দাও বললে কাউন্সিলর বলে, তুমি লিখে দাও যে তুমি ডিভোর্সি মহিলা। এখন আমার শরীরে বাতের প্রবলেম এসেছে। আমি ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছি। আমি কোনোরকম কাজ কাম করতে পারছি না। কী বলব, দুঃখের সঙ্গে জানাব যে কোর্টে সরকারের ব্যবস্থায় রেকর্ড হারিয়ে যায়, এটা সবথেকে আমার দুঃখের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে কার কাছে যাবে মেয়েরা, উকিলদেরকে ঠিক হতে হবে। হাকিমদেরকে ঠিক হতে হবে। বড়ো বড়ো লোকেদের ঠিক হতে হবে। এবং প্রত্যেক মানুষদেরকে সৎ পথে চলতে হবে এবং সৎ বিচার করে দেখতে হবে। তবেই সমাজ পরিবর্তন হবে। নাহলে হবে না। আর বলার নেই। অনেক বড়ো বড়ো লোকজন আছেন। ওনারা বিচার করে দেখবেন, আমাদের মতো নারীদের প্রত্যেকের ফেসিলিটি হয় এবং কোনো নারীকে এরকম অবহেলা করে যে ডিভোর্স করে না দেওয়া হয়।

পুনশ্চ : সংবাদমন্থনে এই বিষয়ে প্রকাশিত এক বছর আগের রিপোর্টটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছিল, তালাকনামা। এবারে সমাবেশে যাওয়ার আগে আমি ওই সংখ্যাটি বেশ কয়েকটি জেরক্স করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে হাজির মহিলাদের দিলামও। কিন্তু তারা দু-একবার উল্টেপাল্টে দেখে সরিয়ে রাখল। আমার মনে হল — শিরোনামটা তাদের পছন্দ হয়নি। তালাকপ্রাপ্তি খুবই অসম্মানের।