- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

পরমাণু বিরোধী দেশব্যাপী প্রচার অভিযান

সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ২৭ ফেব্রুয়ারি#

স্টেশনে লিফলেটিং করছেন এস পি উদয়কুমার, কুডানকুলাম পরমাণু বিরোধী আন্দোলনের নেতা।
স্টেশনে লিফলেটিং করছেন এস পি উদয়কুমার, কুডানকুলাম পরমাণু বিরোধী আন্দোলনের নেতা।

কুডানকুলামের পরমাণু প্রকল্পবিরোধী জন আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ‘পরমাণু মুক্ত ভারতের জন্য’ একটি প্রচার চালাচ্ছেন দেশ জুড়ে। রেলপথে তামিলনাড়ুর কন্যাকুমারী থেকে আসামের ডিব্রুগড় পর্যন্ত অভিযান করা হচ্ছে। এই অভিযানের প্রচারপত্র বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে দিয়েছে কুডানকুলাম আন্দোলনের সহমর্মীরা। বাংলা ভাষায় এই অনুবাদ করেছেন বিস্ময়, পরিমার্জনা করে দিয়েছেন জিতেন নন্দী। প্রচারপত্রটি নিচে দেওয়া হলো।

‘পারমাণবিক শক্তি বিষয়ক আলোচনা শুরু করার আগে আমরা জানাতে চাই যে আমরা উন্নয়নের পক্ষপাতি এবং আমরা চাই ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষের জীবনযাত্রার উন্নয়ন। তাই আমরা চাই যে এদেশে বিদ্যুৎ উত্পাদন বৃদ্ধি পাক এবং আরও নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি হোক।
আমরা পাশাপাশি এটাও বলতে চাই যে, আসুন আমরা পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি-উত্স, যেমন সৌর শক্তি, বায়ূ শক্তি, সমদ্রের ঢেউয়ের শক্তি, জন্তু জানোয়ারের মৃতদেহ ইত্যাদি থেকে আরও বেশি পরিমাণ বিদ্যুৎ তৈরি করা শুরু করি। কারণ অন্ন সুরক্ষা, পুষ্টি সুরক্ষা, সুরক্ষিত জল ও বায়ুর প্রয়োজনীয়তা বিদ্যুতের চেয়ে বেশি।
কিন্তু ভারত সরকার আগামী দিনে এ দেশের কোণায় কোনায় এনার্জি পার্ক বানাতে চলেছে. এই পার্কগুলোয় একই সাথে ৬-১০টি করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকবে। তামিলনাড়ুর কুডানকুলাম ও কলপক্কাম, অন্ধ্রপ্রদেশের কববাদা, ওড়িশার পাতি সোনাপুর, পশ্চিমবঙ্গের হরিপুর, কর্নাটাকের কাইগা, মহারাষ্ট্রের জাইতাপুর ও তারাপুর, গুজরাতের মিঠি বীরদি, রাজস্থানের বাসওবাদা, হরিয়ানার গোরাখপুর, মধ্যপ্রদেশের চুটকা, এইসব জায়গায় আগামী দিনে এই এনার্জি পার্ক তৈরি হতে চলেছে। আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এইসব দেশের সহযোগিতায় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তৈরি হবে। আমেরিকা নিজে গত বেশ কিছু বছরে কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করেনি। জাপানের ফুকুশিমায় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনার পরে জাপান সরকার ওখানকার ৫২টি বিদ্যুত কেন্দ্র বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জার্মান সরকার তাদের দেশে চালু পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই অবস্থায় ভারত কি এইসব পরিত্যক্ত প্রযুক্তির আস্তাকুড় হিসেবে ব্যাবহৃত হবে?
ভারত সরকার অস্ট্রেলিয়া, কাজাকস্তান, নামিবিয়া থেকে ইউরেনিয়াম আমদানি করতে চলেছে। কিন্তু এই দেশগুলিতে কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ মোটেই সস্তা নয় : জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে দীর্ঘমেয়াদি নির্মাণ ব্যয়, ঘুষ, দুর্নীতি, আবর্জনা ফেলার খরচা এইসব মিলিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎ খুবই ব্যয়বহুল।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ মোটেই পরিবেশ বান্ধব নয় : পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের নির্মাণের জন্যে প্রচুর পরিমাণে ইস্পাত, সিমেন্ট, জ্বালানী তেলের দরকার হয়। এই উপাদানগুলি নির্মাণে প্রচুর দূষিত আবর্জনার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় বিপজ্জনক আবর্জনার জন্মও দেয়। এই সব আবর্জনা ৪৮০০০ বছর পর্যন্ত মারাত্মক তেজস্ক্রিয় রশ্মি বিকিরণ করার ক্ষমতা রাখে। এই সব আবর্জনা আমাদের মতো জনবহুল দেশে ফেলা উচিত নয়।
পারমাণবিক বিদ্যুত মোটেই নিরাপদ নয় : আমাদের দেশের মতো জনবহুল দেশে সমান্যতম দুর্ঘটনাও লাখো লাখো জীবন হানি ঘটাতে পারে। ভোপালে যে গ্যাস লিক দুর্ঘটনায় হাজার হাজার লোক মারা যায়, সেই দুর্ঘটনার ৩০ বছর কেটে গেছে. অনেক প্রধানমন্ত্রী মুখ্য মন্ত্রী এসেছেন, গেছেন, কিন্তু আজও ভোপাল দুর্ঘটনা-পীড়িতরা ন্যায়বিচার পায়নি।
পারমাণবিক শক্তি মোটেই স্বাস্থ্যকর নয় : পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঠান্ডা রাখতে প্রচুর জলের প্রয়োজন হয়। এই জল যখন আবার নদীতে বা সমুদ্রে এসে মেশে, তখন সেই গরম জলের সাথে কিছু তেজস্ক্রিয় উপাদানও সমূদ্র/নদীর জলের সাথে এসে মেশে। এগুলি জলে বাস করে এমন জীবজন্তুর পক্ষে ক্ষতিকর। এইসব মাছ, প্রাণী অনেক সময় মানুষের খাদ্য হিসেবে মানুষেরও ক্ষতিসাধন করতে পারে। তাছাড়া, পারমাণবিক চুল্লি আয়োডিন, সিজিয়াম, স্ট্রনশিয়াম, টেলুরিয়ামের মতো উপাদান নির্গত করে, যা গর্ভজনিত সমস্যা, পঙ্গু শিশুর জন্ম গ্রহণ, তেজস্ক্রিয়া জনিত ব্যাধি, এমনকী ক্যানসারের কারণ হতে পারে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন মোটেই নৈতিক নয় : পারমাণবিক চুল্লির ব্যবহার এইসব যাবতীয় সমস্যার সৃষ্টি করতে চলেছে, যার ফলাফল মুখ্যত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর বর্তাবে। এখানে প্রশ্ন হল এই যে, এই অধিকার আমাদের কে দিয়েছে যে আমরা কয়েক বছর বিদ্যুতের সুফল ভোগ করব আর আমাদের কিছু নেতা বিদেশি কোম্পানির থেকে মোটা অংকের বখরা পাবে বলে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এরকম বিপদের দিকে ঠেলে দেব?
পারমাণবিক বিদ্যুৎ মোটেই নিরাপদ নয় : পারমাণবিক বিদ্যুত গ্লোবাল ওয়ার্মিং কমাতেও কোনো কার্যকর উপায় নয়। তাছাড়া পারমাণবিক আবর্জনা পৃথিবীর বুকে বিষ ভরে দেয়। এই পৃথিবীতে মোট উত্পাদিত বিদ্যুতের মাত্র ২ শতাংশ পারমাণবিক চুল্লি থেকে আসে।
আমরা কি আমাদের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতা এত সহজে বন্ধক দিয়ে আবার পরাধীনতার দিকে এগোব? নাকি যে কোনো স্বাধীন দেশের মতো আমাদের সমস্যার সমাধান করব গণতান্ত্রিক উপায়ে?
মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন ‘এই পৃথিবীর আলো বাতাস, জমি, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি বলে তাকে ভোগ করে শেষ করে দিলে আমরা ভুল করব। বরং আমাদের মনে রাখা উচিত এইসব সম্পদ আসলে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ঋণ হিসেবে নিয়ে ব্যবহার করছি মাত্র। আমাদের কর্তব্য এইসব সম্পদ তাদের হতে সপে দেওয়া, ঠিক যেমন ভাবে আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদেরকে তা দিয়েছেন।’
আসুন আমরা এক পারমাণবিক শক্তি মুক্ত ভারতের কল্পনা করি, যেখানে কোনো পরমাণু চুক্তি নেই, কোনো পরমাণু চুল্লি নেই, কোনো পারমাণবিক বোমা নেই, কোনো পরমাণু আবর্জনা নেই। ‘