- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

নয়া সক্ষমতায় জেগে উঠছে নেপালের গ্রাম ও চাষিসমাজ, বিশেষত মেয়েরা

স্টিফেন মাইকসেল, চিতওয়ান, নেপাল, ৯ জানুয়ারি#

জৈব চাষি চন্দ্র, চাষি মেয়েদের বলছেন জৈব চাষের গুরুত্ব -- নেপালের চিতওয়ান জেলায় ফুলবাড়ি গ্রাম থেকে ছবিটি পাঠিয়েছেন স্টিফেন মাইকসেল। ১৪ জানুয়ারি।
জৈব চাষি চন্দ্র, চাষি মেয়েদের বলছেন জৈব চাষের গুরুত্ব — নেপালের চিতওয়ান জেলায় ফুলবাড়ি গ্রাম থেকে ছবিটি পাঠিয়েছেন স্টিফেন মাইকসেল। ১৪ জানুয়ারি।

গতকাল আমি সারাদিন কাটালাম নেপালের জাতীয় চাষি সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে স্থানীয় ইউনিটগুলোর কয়েকশো প্রতিনিধির মধ্যে, যাদের ভেতর ষাট শতাংশই মহিলা। আমি কখনো এত শক্তিশালী, দৃঢ়, ভাবনায় ভরপুর, লা-জবাব সুকঠিন সৌন্দর্যের মহিলাদের নম্র সুন্দর পুরুষদের সঙ্গে একই ঘরে বসে থাকতে দেখিনি। প্রায়শই এইসব মিটিংয়ে ছেলেরাই আধিপত্য করে। এখানে মোটেই তা হল না। যাদের কথা পছন্দ হচ্ছিল না, তাদের চিল্লিয়ে বসিয়ে দিতে মেয়েরা একটুও কসুর করেনি। ছেলেরাও মেয়েদের মতোই সমান ভালো। তারাও মেয়েদের সমান বলেই মনে করছিল। এ এক বিশেষ মুহূর্ত। খুবই চাঁচাছোলা আলোচনা হচ্ছিল সব। কোনো নেতা নেই, কেউ কাউকে পরে বলিস বলে থামিয়ে দিচ্ছিল না। সামনের সারিতে বসে থাকারা সেখানে বসে আছে বলে বিশেষ শ্রদ্ধা পাবে, মোটেই সেরকম কিছু হচ্ছিল না। আহ্বায়করা কাকুতি মিনতি করে একটু বলার সুযোগ পাচ্ছিল মাঝে মাঝে। তাও তাদের কথা শোনা হচ্ছিল রীতিমতো শর্তসাপেক্ষে।

শীলা, আমার চাষিবন্ধু চন্দ্র-র বৌমা বলছিল কিছুক্ষণ আগে, ‘মা এই খামারের শিরদাঁড়ার মতো। যা কিছু হয়েছে সব তার জন্যই হয়েছে। চন্দ্র কাগজে কলমে সব বলে দেয়, আর ও সব কাজ করে। এই জৈব উৎপাদনগুলো সব তার।’ এই সত্যিটা সমাজের সর্বক্ষেত্রে সাধারণ সত্য বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এই চাষিরা সত্যিটা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল।

এই চাষি সংগঠনটি কেবল তিন বছর বয়স। কিন্তু দেশের অর্ধেকের মতো অঞ্চলে এর প্রসার হয়েছে এরই মধ্যে। এর স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং কেন্দ্রীয় সংগঠন রয়েছে। তারা (চাষিরা) বুঝে গেছে, তাদের কথা ভাবা হয় না, পাত্তা দেওয়া হয় না। এবং তারা যদি নাক না গলায়, তাহলে সংবিধান লেখা ও তার রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতে তাদের কোনো প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। অনেক রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাশালী হয়েছে। কিন্তু তাদের স্বার্থ কেউ দেখেনি। তারা এখন ক্ষমতা তৈরি করছে পাল্টা লড়াই করার জন্য।

আমার মনে হল, গতবারের তুলনায় এবারে আমি এক নয়া দেশ দেখছি। চাষিরা নিজেদের ক্ষমতায় জেগে উঠেছে, বিশেষ করে মেয়েরা। ছ-বছর আগে আমি অনেকগুলো গ্রামে গিয়েছিলাম, যেখানে ছেলেরা সব বিদেশে চলে গেছে কাজের খোঁজে এবং মেয়েরা সব চাষবাস ও সমাজের বাকি সব কাজ করছে। সে সময় আমি লিখেছিলাম, এক বিশাল আত্মসচেতনতা তৈরি হচ্ছে এবং আন্দাজ করেছিলাম, এই মেয়েরা বিপুল এক সক্ষমতার অধিকারী হতে চলেছে। আমার এখন মনে হচ্ছে, তা ঘটতে দেখছি।

শহরের লোকেরা কেমন ফালতু। তারা মনে করে তারা খুব স্মার্ট, কারণ তারা দামি স্কুলে যেতে পারে, ভোগ্যদ্রব্যের পেছনে ছুটতে পারে সবসময়। কিন্তু এই চাষিরা, বিশেষ করে তাদের মধ্যে যারা লিখতে পারে না, তারা এই জগৎকে অনেক ভালো বোঝে। এই মহিলাদের বোঝাপড়া তো খুবই সূক্ষ্ম। তারা জানে, তারা সমাজ গড়ছে, কেবল ফসল ফলাচ্ছে, তা নয়। তারা জানে যে তারা নিজেদের জীবনের জন্য লড়ছে, এই মাটির জীবনের জন্য লড়ছে। কিছু পুরুষ এখনও বিভ্রান্ত, রাসায়নিক কোম্পানিগুলো থেকে জিনিসপত্র এনে দিচ্ছে মাটিতে। কিন্তু মেয়েরা জানে কোনটা কী। এখানে কত প্রাণপ্রাচুর্য, ভবিষ্যৎ দৃষ্টি। আর তারা জানে, এটা কেবল তারাই কার্যকর করতে পারে। শহরের লোকেরা যখন টেলিভিশন সেটের সামনে বসে বসে নিরন্তর গাল পেড়ে যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে, তাদের পায়ের তলায় একটা আগ্নেয়গিরির উদ্গীরণ শুরু হচ্ছে।