- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

নোনাডাঙায় জোর করে ভাঙা হল দুটি বস্তি

শমীক সরকার ও শ্রীমান চক্রবর্তী, নোনাডাঙা, ৩০ ও ৩১ মার্চ

 

৩০ মার্চ নোনাডাঙায় বছরখানেকের পুরনো দুটি বস্তি, মজদুর কলোনি এবং শ্রমিক কলোনি ভেঙে গুঁড়িয়ে পুড়িয়ে দিল কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ)। অন্তত তিনটি বুলডোজার, কয়েক গাড়ি পুলিশ, প্রিজন ভ্যান, এবং তিনটি দমকল এই উচ্ছেদ অভিযানে সামিল হয়। সকালে উচ্ছেদ প্রতিরোধে বস্তির বাসিন্দা মহিলারা বুলডোজারের সামনে দাঁড়ালেও প্রতিরোধ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এর মধ্যে বস্তির কয়েকটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। বাসিন্দাদের অভিযোগ, আগুন লাগিয়েছে পুলিশ। ঘরগুলি চাটাই বেড়া এবং টালি-প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয়েছিল। কিছু ঘরে টিন দেওয়া ছিল।
কলকাতার সৌন্দর্য্য বাড়াতে গিয়ে বস্তি উচ্ছেদ চলছে আজ প্রায় দেড় দশক ধরে। সরকার বদল হলেও সেই ধারায় ভাঁটা পড়েনি। সেই উচ্ছেদ

ভাঙার পর কুড়িয়ে নেওয়া চাটাই, বাঁশ।
সবাই মিলে রান্না। ছবি প্রতিবেদকের।

হওয়া মানুষজনের পুনর্বাসনের জন্য আগের সরকার বেছে দিয়েছিল ইএম বাইপাস থেকে আরও পূর্ব দিকের নোনাডাঙা এলাকাকে। উচ্ছেদ হওয়া মানুষ সেখানেই অস্থায়ী ঘর বানিয়ে থাকছিল। তারপর কিছু একচিলতে ফ্ল্যাট তৈরি করে সরকার। আশ্রয় পায় কিছু উচ্ছিন্ন মানুষ।
কিন্তু শহর জুড়ে নতুন নতুন বস্তি গজিয়ে ওঠার বিরাম ঘটেনি। দক্ষিণবঙ্গের চাষের সঙ্কট যত তীব্র হয়েছে, তত গ্রামের মানুষ চলে এসেছে শহর কলকাতায়, জীবিকা ও আশ্রয়ের খোঁজে। ২০০৯ সালের আয়লা ঝড়ে দক্ষিণবঙ্গ, বিশেষত সুন্দরবনের চাষআবাদ ও বসবাস প্রায় শিকেয় ওঠার পর সেই ঝোঁক আরও বেড়েছে। কলকাতার অন্যান্য জায়গা থেকে উচ্ছিন্ন মানুষ আর দক্ষিণবঙ্গের গ্রাম ছেড়ে চলে আসা মানুষ নোনাডাঙার পুনর্বাসনের শহরে তৈরি করেছে বসতি।
নোনাডাঙার উচ্ছেদের পর বৌ বাচ্চা নিয়ে ভেঙে দেওয়া ঘরের জায়গাটায় ঠা ঠা রৌদ্রের মধ্যে দুপুরবেলায় একটা প্লাস্টিকের আড়াল নিয়ে বসেছিলেন সুকান্ত হালদার। বছর পঞ্চাশেক বয়স, পেশায় ঠিকা নির্মাণকর্মী, বৌ লোকের বাড়ি ঠিকে কাজ করে। জানালেন, ফলতার সহরারহাটেরও
ভেতরের দিকে বাড়ি ছিল। গ্রামে কিছু নেই। আগে ভাড়া ছিলেন ৪২ বাসস্ট্যান্ডের কাছে। কিন্তু ভাড়া অনেক। তারপর লোকমুখে শুনলেন, নোনাডাঙায় বসা যাচ্ছে। এখানে এসে চাটাই টালি দিয়ে ঘরটা গড়েছেন তিন সাড়ে তিন মাস হল। বেশ কয়েক হাজার টাকা খরচ হয়েছে, বৌ যার বাড়ি কাজ করে, তার কাছ থেকে কিছু ধার করেছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, এখানে এসে বসার জন্য কেউ কি টাকা চেয়েছিল? উত্তর দিলেন, না কেউ চায়নি।
উচ্ছেদের পর বাসিন্দারা কুড়িয়ে রাখছিলেন আস্ত টালি, চাটাই, বাঁশ। জোরে চিৎকার করে এক মহিলা বলছিলেন, যাব কোথায়, এখানেই থাকব।
তাঁবু খাটিয়ে থাকব।
পরদিন দুপুরে দেখা গেল, মজদুর কলোনির কেউ কেউ এখান ছেড়ে চলে গেছে কোথাও। বাকিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দিন আনি দিন খাওয়া পরিবারগুলির কেউ কেউ চুপচাপ বসে আছে। একটা তাঁবু খাটিয়ে এক গামলা খিচুড়ি রান্না হয়েছে, মাটির উনুনে কড়াইতে বসেছে সিম বেগুনের তরকারি, উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের সহায়তায়। সেই তাঁবুর কাছে দাঁড়িয়ে গোসাবা থেকে আয়লার পর কলকাতায় চলে আসা সহদেব হালদার জানালেন, তিনি নোনাডাঙায় এসেছেন ২০১০ সালে। এই মজদুর কলোনিতে ঘর করেছিলেন একদম শুরুর দিকে। অনেকগুলি ঘর তাঁর পরিবারের। তিন ছেলে এক বৌমা নাতি নাতনি নিয়ে। কতঘর ছিল এই বস্তিটায়? প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, দেড়শো ঘর।
ফ্ল্যাটে যারা পুনর্বাসিত হয়েছে বছর কয়েক আগে, তাদের একজন মধ্যবয়স্ক দেব দাস, রান্নার কাজ করেন। তিনি এই বস্তিগুলি উচ্ছেদ হওয়ায় আনন্দ প্রকাশ করছিলেন। তাঁর বয়ান, পুনর্বাসন ফ্ল্যাটেরই কেউ কেউ পয়সা দিয়ে সামনে লোক বসাচ্ছে। মজদুর কলোনির ঠিক পাশের আরেকটি বস্তি লেক কলোনি। বছর তিনেক আগে তৈরি। সেখানকার বাসিন্দারাও এই তুলনায়-নতুন বস্তিবাসীর সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। এই অনৈক্যের বাতাবরণ নোনাডাঙার উচ্ছেদ সহজ করে দিয়েছে নিঃসন্দেহে। রান্নার তাঁবুর পাশে দাঁড়িয়ে সদ্য উচ্ছেদ হওয়া চঞ্চল বলছিলেন, মন্ত্রী বলে গিয়েছে, এখানে ছ’টা বস্তি উচ্ছেদ হবে। সবে দুটো হয়েছে। অদূরেই একটি ছোটো এবং তুলনায় পুরনো বস্তি সুভাষ পল্লিও সেই উচ্ছেদের তালিকায় আছে, জানা গেল।
কেন উচ্ছেদ? প্রশ্নের উত্তরে নোনাডাঙার ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এবং বস্তিবাসীদের সমর্থক বাপি মণ্ডল জানালেন, নোনাডাঙার নতুন টাউনশিপে অনেক শিল্প কারখানা হবে। তাছাড়া চৌদ্দ ছটাক করে প্লট করে এই ফ্ল্যাটের সামনের জায়গাগুলোকে অন্য কোনও আবাসন প্রকল্পকে বেচে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। তাই এই উচ্ছেদ।
৩১ মার্চ বিকেলে রুবির মোড় থেকে নোনাডাঙা পর্যন্ত উচ্ছেদবিরোধী একটি মিছিল হয়।