- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

নোনাডাঙার উচ্ছেদ হওয়া বস্তিবাসীরা আমাদের সহনাগরিক

পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী বলেছেন, ‘পুনর্বাসন না-দিয়ে উচ্ছেদের পক্ষপাতী আমরাও নই, তবে নতুন করে দখল করতে দেওয়া যাবে না’।
কেন পুনর্বাসন দেওয়া হবে? ওই বস্তির লোকেরা আপনাদের ভোটের মিছিলে হেঁটেছে বলে? নিশ্চয়ই নয়। পুনর্বাসনের যৌক্তিকতা আজ রাষ্ট্রসংঘ থেকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট সহ বহু প্রতিষ্ঠানই স্বীকার করে নিয়েছে। কেন? কারণ মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে বাধ্য হয়। গ্রাম থেকে শহরে আসার কারণ অনেক। যেমন, ২০০৯ সালের আয়লা ঝড়ের প্রকোপে নোনা জলের তাণ্ডবে চাষ-বাস হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ সুন্দরবনের নানা দ্বীপ থেকে পালিয়ে এসেছে বাঁচবার জন্য, জীবিকার জন্য। সাধ করে কেউ ভিটেমাটি ছেড়ে এখানে বেড়াতে আসেনি। সুন্দরবনে ঘূর্ণিঝড় দু-এক বছর অন্তর হয়। ১৯৮৮ সালেও মারাত্মক এক ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালেও হয়েছে। এখন আমরা কি বলতে পারি ১৯৯৯ সালের উদ্বাস্তুরা ঠাঁই পাবে, ২০০৯-এর উদ্বাস্তুরা পাবে না?
শুধু বন্যা খরা আর প্রাকৃতিক দুর্যোগেই নয়, বহু গ্রামের মানুষ আজ  চাষ করে বেঁচে থাকার রসদ জোগাড় করে উঠতে পারছে না। গ্রামে যদি সে কিছু রোজগার না করে উঠতে পারে, সে শহরে আসে — কলকাতা, দিল্লি, মুম্বই আর বহু শহরে সে পাড়ি দেয়। এখন কলকাতার মতো শহরে যা বাড়িভাড়া, সামান্য রোজগারে অনেকেই তা কুলিয়ে উঠতে পারে না। তাকে তখন খোলা জায়গায় ঝুপড়ি করে আস্তানা গাড়তে হয়। শুধু নোনাডাঙাই নয়, এরকম বহু বস্তি শহরের আশপাশে, প্রান্তে, মফস্বলে গড়ে ওঠে। কলকাতায় যেমন বেশ কিছু পুরোনো বস্তি রয়েছে, তেমনি তৈরি হয়েছে অনেক নতুন বস্তি।
ণ্ণউন্নয়ন’ বলতে যেসব গালভরা প্রকল্প সরকার ঘোষণা করে, সেখানে এই বাস্তবতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব আর মর্যাদা দিয়ে দেখা হয় না। যারা যখন সরকারি ক্ষমতায় এসেছে, সে পুরোনো কংগ্রেস, বামফ্রন্ট হোক বা নতুন তৃণমূল, সেই ক্ষমতার দাম্ভিক ভাষাতেই কথা বলেছে, পুলিশ দিয়ে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করতেও কসুর করেনি। শুধু রাষ্ট্র-ক্ষমতাই নয়, রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা, আর্থিক ক্ষমতা, লেখাপড়া জানা ভদ্দরলোকদের ক্ষমতা কখনই এই বস্তিবাসীদের সম নাগরিকের মর্যাদা দেয়নি। পার্টিওয়ালারা নিজেদের মিছিলে লোক বাড়ানোর জন্য এই বস্তিগুলোকে ব্যবহার করেছে, মস্তানরা তাদের অপকর্মের ঠেক হিসেবে এগুলোকে ব্যবহার করেছে, বাবুরা ঝি আর মুটেমজুর সাপ্লাইয়ের জন্য এই বস্তিগুলোকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু কেউ এদের প্রতিবেশীর মর্যাদা দেয়নি।
তাই আজ যারা নোনাডাঙায় ঘর আর আসবাবপত্র হাঁড়িকুড়ি খুইয়ে খোলা আকাশের নিচে অসহায়ভাবে পড়ে রয়েছে, যদি সত্যিই আমরা ওদের সহমর্মী হই, আমরা কখনই পুরমন্ত্রীর ভাষায় বলতে পারি না ণ্ণনতুন করে দখল করতে দেওয়া যাবে না’, কখনই আমরা ওদের মধ্যে ভাগ করে ফায়দা লোটার কথা মোটেই ভাবতে পারি না। হ্যাঁ, ওদের নিজেদের মধ্যেও ঘটি-বাঙালের লড়াই আছে, কে আগে এসেছে আর কে পরে এসেছে তা নিয়ে বিবাদ আছে, কে সিপিএম আর কে তৃণমূল তাই নিয়ে বড়াই আছে। কিন্তু আমরা কলকাতাবাসী সেই ঝগড়ার ফায়দা নেব কেন?