- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

নৈশভ্রমণে

তিন্নি দাস, কলকাতা, ২০ জুন#
আমরা তিন বন্ধু মিলে একদিন সারারাত কলকাতার রাস্তায় ঘুরব বলে ঠিক করলাম। রাতের কলকাতা ঠিক কেমন হয় দেখার জন্য। আমি, রিনি আর রূপম। সত্যি কথা বলতে কি বেশ ভয় ভয়ই লাগছিল । এই ধরণের অহেতুক বাউণ্ডুলেপনা আগে কখনো করিনি, অদ্ভুত লাগছিল তাই। রাতের বেলার রাস্তা যে চোর ডাকাতদের আখড়া সে তো সবাই জানে। তাছাড়া আমাদের শহরের নিতান্ত নিরীহ নেড়ি কুকুরেরা রাতের বেলা বেশ খারাপ মেজাজে থাকে, যখন তখন দল বেঁধে তেড়ে আসতে পারে। আমাদের গায়ে বিশেষ জোর নেই, অস্ত্র বলতে ছাতাই একমাত্র সম্বল, আমি তো খুব একটা জোরে দৌড়াতে পর্যন্ত পারি না। যাইহোক সাধ যখন হয়েছে তখন তা মিটিয়ে নেওয়াই ভালো।
প্রথমে ঠিক করা হল মেডিকেল কলেজ চত্বরে যাব, সেখানে নাকি একটা চায়ের দোকান আছে যেটা সারারাত খোলা থাকে, সেখানেই বসব। বাসে যখন চড়লাম তখন রূপম বলল যে ময়ুখ নামে ওর এক বন্ধু আছে, সেও আমাদের সঙ্গে থাকবে। সে এক্সাইডের মোড়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। বাস থেকে নেমে আমার মনে হল যে পিজি হাসপাতালের সামনেও তো লোকজন থাকার কথা। তাছাড়া ভবানীপুরে আমার পুরনো পাড়া। মাঝরাতে পাড়াতে ঢুকে আমার বহুচেনা বাড়ি গুলোকে দেখব। ওদেরকে বললাম, ওরাও আমার কথায় রাজি হয়ে গেল।
ময়ুখের সঙ্গে দেখা হল। ও আর রূপম আগেও রাস্তায় রাত কাটিয়েছে। স্কুল পালানো ছেলে হওয়ার সুবিধা আরকি। ওরা বলল বেশি কিছু না খেতে, তাহলে নাকি রাত জাগতে অসুবিধে হবে, ঘুম পেয়ে যাবে। অগত্যা এক প্যাকেট বিস্কুট কেনা হল। আমরা প্রথমে বসেছিলাম আকাদেমি চত্বরে। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে লাগল। আমরা গল্প করছিলাম। ক্রমশ লোকজন সবাই চলে গেল। চায়ের দোকানি চাদর মুড়ি দিয়ে দোকানের ভিতরের বেঞ্চেই গুটিসুটি মেরে ঘুমাতে লাগলেন। সামনের সুলভ শৌচালয়ে তালা দিয়ে চলে গেল  সবাই। ‘যদি কিছু হয়’ ভয়টা ক্রমশ কেটে যেতে লাগল। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যাও কমতে লাগল।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে পুরনো পাড়ায় গেলাম। সব বাড়ির দরজা বন্ধ। আমি ঘুরে ঘুরে ওদেরকে সব দেখালাম- কোন বাড়িতে কে থাকে, খেলার মাঠ, সরস্বতী পূজোর প্যান্ডেল কোথায় করা হয় প্রতি বছর, এইসব ছোটখাট টুকিটাকি জিনিস। এমন অনেক কথা যা ‘বোকাবোকা শোনাবে’, বা ‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়’ বলে বলা হয় না, সেসব কথাও অনায়াসে বলে ফেলা যাচ্ছিল। তারপর আমরা ফের হাঁটতে শুরু করলাম পার্ক স্ট্রীট লক্ষ্য করে। দিনের বেলায় যে রাস্তা অনেক দূর বলে মনে হয়, রাতের বেলা তা যেন কেমন কম কম ঠেকে।
বিড়লা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে এসে আমাদের পুলিশ ধরল। মানসিক প্রস্তুতি ছিলই আমাদের। রাতের বেলা রাস্তায় ঘুরলেই পুলিশ ধরে। কিন্তু ধরলে ঠিক কী যে করব তার কোন পূর্বপরিকল্পিত প্ল্যান করে আসিনি। দু-জন পুলিশ অফিসার প্রথমেই রূপমের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর ভীষণ বকাবকি করতে লাগল – এত রাতে ‘লেডিস’ সঙ্গে করে রাস্তায় বেরোনোর মত বোকামি করার জন্য। আমি তখন গিয়ে ক্ষমা-টমা চেয়ে, কোণ রাস্তা দিয়ে যাওয়া কম বিপজ্জনক ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করলাম। তারপর তারা আর বিশেষ কথা বাড়াল না, আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আবার হাঁটছি। এটিএম কাউন্টারের সামনের সিকিউরিটি গার্ড চেয়ারে বসে বসেই ঘুমাচ্ছেন। শেষমেশ পার্ক স্ট্রীট পৌঁছালাম, সেই নাম করা রোলের দোকান বন্ধ। আমরা তার পাশে বসে গান জুড়লাম। তখনো বেশ কিছু নাইটক্লাব খোলা। মাঝেমাঝেই লোকজন বেরিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছে সাঁ করে। একজন ভদ্রমহিলা দাঁড়িয়ে আছেন একা একা গাড়ির সামনে, বেশ বয়স্কা। সম্ভবত পেশায় তিনি দেহব্যবসায়ী, কারণ ময়ুখ বলল যে ও ওনাকে আগেও ওখানে রাতেরবেলা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি একটা শিফন শাড়ি পড়ে, কেউ আসেনা। মাথাটা গুলিয়ে যেতে থাকে। নাকের ডগায় ড্রেন থেকে বেরিয়ে এসছে অনেক ধেড়ে ইঁদুর। কলকাতা শহরটা রূপকথার গল্পের হ্যামলিন মনে হচ্ছে।
আবার দুজন পুলিশ এল বাইক চালিয়ে। এবারও মেয়েদের পাত্তা না দিয়ে রূপমের সঙ্গে বাক্যালাপ করতে লাগল। আমি আবার উঠে গিয়ে নাক-গলিয়ে হাজারটা গুল দিয়ে তাদেরকে বিদায় করলাম। বেশ গর্বই লাগছিল পুলিশের ব্যাপারটা এত সুন্দর ম্যানেজ করতে পেরে।
তারপর পাখির ডাক শুরু হল, আকাশের রঙ ফিকে হয়ে উঠল আমরা ধর্মতলায় গিয়ে চা খেলাম। তারপর বাসে চেপে বাড়ি এসে সেই যে ঘুমালাম, বিকেলের আগে আর উঠিনি।