- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

নেতাজী ও আজাদ হিন্দ ফৌজ

সৌমিত্র গোস্বামী, ২৬শে ডিসেম্বর , ম্যাগাজিন রোড এক্সটেন্সন্‌, কোচবিহার#
বছর ঘুরে আর একটা ২৩শে জানুয়ারী আসছে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করেছে নরেন্দ্র মোদীর বি.জে.পি সরকার। এই সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভোটের আগে অনেক গালভরা প্রতিশ্রুতির একটি ছিল বহুদিন যাবৎ কেন্দ্রের আলমারিতে বন্ধ হয়ে থাকা নেতাজী সুভাষ বোসের নিরুদ্দেশ সম্পর্কিত ফাইলগুলি জনসমক্ষে আনা। আমরা দেশের সাধারন মানুষেরা এই প্রতিশ্রুতিতে উৎফুল্ল হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম এবারের ২৩শে জানুয়ারী বোধহয় একটু অন্যরকম হবে, অনেক দ্বিধা অনেক দ্বন্দ্বের বোধহয় অবসান হবে এবার। কিন্তু হায়, ভোটের রাজনীতি বড় নোংরা রাজনীতি যেখানে নেতাজীর মত ব্যক্তিত্বকে নিয়েও নেতাদের রাজনীতি করতে বাধে না। আমরা আবার আশাহত কারন কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যে ঘোষনা করে দিয়েছে যে বিশেষ কিছু কারনের জন্যে নেতাজী সম্পর্কিত ফাইলগুলি প্রকাশ্যে আনা যাবে না। প্রতিবারের মত এবারেও ২৩ জানুয়ারী কাটবে অনেক দ্বিধা অনেক দ্বন্দ্ব অনেক হতাশায়।
যাই হোক আমার উদ্দ্যেশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করা নয়। অনেকের মত আমারো দাবী নেতাজী সম্পর্কিত ফাইলগুলি প্রকাশ্যে আনা হোক এবং আমার আশা ফাইলগুলি একদিন প্রকাশ্যে আসবেই, সত্য উদ্‌ঘাটিত হবেই।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসকে নিয়ে অনেক বই, অনেক লেখা অনেক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। তাই নতুন করে কিছু বলার নেই, বরং সংক্ষেপে কিছু বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যাক।
বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে, অনুষ্ঠানের ক্যুইজে বলা হয় এবং অধিকাংশ মানুষ জানে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেছিলেন রাসবিহারী বসু। কিন্তু এই তথ্য সঠিক না। ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠন করেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ১৯৪১ সালের ১২ই ডিসেম্বর জার্মানীতে আর রাসভারী বসু গঠন করেন ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগ’ আর এই ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের’ অধীনে ক্যাপ্টেন মোহন সিংহের নেত্তৃত্বে ১৯৪২ সালের ১লা সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরে গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি’ বা INA , ১৯৪১ সালের ৭ই ডিসেম্বর জাপান পার্ল হার্বার আক্রমন করে দখল করে নেয়। ১৯৪২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী জাপান সিঙ্গাপুর দখল করে। সে সময়ে ব্রিটেনের অস্তিত্ব ছিল সঙ্কটজনক। হাজার হাজার ব্রিটিশ সৈনিক জাপানীদের কাছে আত্মসমর্পন করেছল। এর মধ্যে ছিল ৩২ হাজার ভারতীয় সৈনিক। ১৯৪২ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী সিঙ্গাপুরের ফের্জ পার্কে সেই বন্দী ৩২ হাজার ভারতীয় সোইনিকদের মেজর ফুজিওয়ারা ক্যাপ্টেন মোহন সিংহকে সমর্পন করেন, তাদের নিয়েই গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশানাল আর্মি’ বা INA. দুই বাহিনীর পতাকাও ছিল ভিন্ন। আজাদ হিন্দ ফৌজের পতাকা ছিল তেরঙ্গা আর মাঝের সাদা অংশে ছিল ঝাঁপিয়ে পড়া বাঘ। আর INA র পতাকা ছিল চরকা চিহ্নিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জাতীয় পতাকা। আজাদ হিন্দ ফোউজের স্লোগান ছিল ‘আজাদ হিন্দ জিন্দাবাদ’ আর INA-র স্লোগান ছিল ‘আজাদ হিন্দুস্তান’।
১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে নেতাজী জার্মান সরকারের আর্থিক সাহায্যে অ বেতার সম্প্রচারের এক বিশেষ চ্যানেলের মাধ্যমে ‘আজাদ হিন্দ বেতার কেন্দ্র’ খুলে ভারতের ১৪টি ভাষায় ব্রিটিশ বিরোধী প্রচার চালানোর উদ্যোগ নেন। এরপর নভেম্বর মাসে জার্মানীর এক প্রেক্ষগৃহে আয়োজিত এক সভায় সুভাষ চন্দ্র বোস প্রথম ‘নেতাজী’ নামে সম্বোধিত হলেন এবং সেই সভায় তিনি গঠন করলেন ‘আজাদ হিন্দ সঙ্ঘ’। ১৯৪১ সালের ১১ই ডিসেম্বর নেতাজী জার্মানীর অয়ানাবার্গ বন্দী শিবির পরিদর্শন করেন এবং এই শিবিরের ১০ হাজার ভারতীয় যুদ্ধবন্দীর উদ্দ্যেশ্যে ভাষন দেন এবং তাদের ‘আজাদ হিন্দ সঙ্ঘে’ যোগ দিয়ে ভারত মাতার শৃঙ্খল মোচনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। ১২ই ডিসেম্বর প্রায় সাড়ে তিন হাজার ভারতীয় সৈনিক স্বেচ্ছায় ‘আজাদ হিন্দ সঙ্ঘে’ যোগ দেয় এবং এই ‘আজাদ হিন্দ সঙ্ঘে’র নাম পালটে হয় ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’।
১৯৪২ সালের ১লা সেপ্টেম্বর রাসবিহারী বসু ও ক্যাপ্টেন মোহন সিংহের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে INA, কিন্তু প্রবল মত পার্থক্যের জেরে মাত্র সারে তিন মাসের মধ্যে ভেঙ্গে যায় INA. এরপর ১৯৪৩ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী রাসবিহারী বসু আর একবার INA গড়ে তোলেন নব কলেবরে, কিন্তু তখনও ছিল প্রবল মতপার্থক্য। এরপর ১০ই জুলাই নেতাজী INA- র নেতৃত্বভার গ্রহন করেন এবং INA মিশে যায় আজাদ হিন্দ ফৌজের সঙ্গে।
১৯৪৫ সালের ৬ই ও ৯ই আগষ্ট আমেরিকা জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকির উপর পরমানু বোমা ফেলে। তারপর জাপান আত্মসমর্পন করলে নেতাজী ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগষ্ট ব্যাঙ্কক থেকে টোকিও যাবার জন্যে বিমান যাত্রা করেন। ২৪শে আগষ্ট টোকিও রেডিও থেকে প্রচারিত হয় যে ফরমোজার কাছে তাইহোকু নামক স্থানে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস প্রাণ হারিয়েছেন।
এখানেই যাবতীয় রহস্য ও প্রশ্নের উৎপত্তি। নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য উদ্‌ঘাটিত করার জন্যে জাস্টিস মনোজ মুখার্জী অনেক তদন্ত করেছিলেন যা মুখার্জী কমিশন নামে পরিচিত। ৭ বছর তদন্তের পর তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌছিয়েছিলেন যে নেতাজী বমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও সেই মুখার্জী কমিশনের রিপোর্ট আজ অবধি প্রকাশিত হয়নি। তাইহোকুর তৎকালীন ও বর্তমান কর্তৃপক্ষ লিখতভাবে মুখার্জী কমিশনকে জানিয়েছিলেন যে ঐদিন কোনও বিমান দূর্ঘটনা ঘটেনি। তাহলে রেনকোজির মন্দিরে রাখা চিতাভস্ম আসলে কার? এবং ফরমোজার সরকারও জানিয়েছে যে তাদের কাছে এ ব্যাপারে কোনও তথ্য নেই।
ঐদিন নেতাজীর সাথে বিমানে ছিলেন এস.কে.আয়ার, কর্নেল হাবিবুর রহমান এবং কর্নেল প্রীতম সিং আর জাপানী অফিসার নেগেসি। এস.কে.আয়ার ছিলেন আজাদ হিন্দ সরকারের প্রচারমন্ত্রী। এই আয়ার খোসলা কমিশনকে জানিয়েছিলেন সাধারন বিমানে কিন্তু নেগেসি খোসলা কমিশনকে জানিয়েছিলেন তারা রওনা দিয়েছিলেন বোমারু বিমানে।
প্রশ্ন আরো আছে যেমন বিমান দুর্ঘটনায় মারা না গেলে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের জীবনে শেষপর্যন্ত কি ঘটেছে? গুমনামী বাবা আসলে কে? মুখার্জী কমিশন বা খোসলা কমিশনের রিপোর্ট সহ নেতাজী সম্পর্কিত ফাইলগুলি প্রকাশ্যে আসার অসুবিধে কোথায় বা এই না আসার পেছনে কার কোন স্বার্থ জড়িয়ে আছে? ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্নগুলোর উত্তর কোনওদিনই কি পাওয়া যাবে?