- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

নাগরি মিয়াপুর বাথানিটোলার পর বাথে, পাটনা হাইকোর্টে দলিত গণহত্যায় অভিযুক্তদের বেকসুর খালাসে বিচারব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন

এটি সংবাদমন্থন ওয়েবসাইটে পাওয়া একটি ‘অতিথি খবর’, প্রতিবেদক নাম উল্লেখ করেননি। সংবাদটি সম্পাদনা করেছেন শমীক সরকার, ৮ নভেম্বর#

bw-court

গত শতকের শেষ দশকের শেষের ক’টি বছর বিহারে উচ্চবর্ণের সশস্ত্র সংগঠনগুলি (রণবীর সেনা প্রভৃতি) দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর একের পর এক গণহত্যা চালিয়েছিল, তা সেসময় ছিল খবরের শিরোনাম। ফের একবার বাথানিটোলা, লখিমপুর জায়গাগুলি খবরে এসেছে, ফের একরাশ লজ্জা সঙ্গে নিয়ে।
পাটনা হাইকোর্ট সম্প্রতি ১৯৯৭ সালের লখিমপুর গণহত্যার রায় দিয়েছে। যে গণহত্যায় নারী ও শিশু সহ ৫৭ জন দলিত মানুষকে নৃশংস ভাবে খুন করা হয়েছিল, তার কোনও একজন খুনিকেও শাস্তি দেবার উপযুক্ত বলে উচ্চ আদালত খুঁজে পায় নি। গত ৯ অক্টোবর লখীমপুর বাথে গণহত্যার রায় দিতে গিয়ে পাটনা হাইকোর্ট এমনকি নিম্ন আদালতের রায়কেও সম্পূর্ণ উলটে দিয়েছে। নিষিদ্ধ সন্ত্রাসবাদী সংগঠন রণবীর সেনার যে ২৬ জনকে উচ্চ আদালতের এই রায়ে বেকসুর খালাস করা হয়েছে নিম্ন আদালত তাদের মধ্যে ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ১০ জনকে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা দেবার মত মারাত্মক অপরাধের প্রমাণ পেয়েছিল। স্তম্ভিত হওয়ার মতো এই রায়।
গত দেড় বছরের মধ্যে বিহার হাইকোর্ট লখিমপুর বাথে এবং বাথানিটোলা সহ তাদের দেওয়া চারটি রায়ে দলিত হত্যায় অভিযুক্ত এবং নিম্নতর আদালতে ফাঁসি বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মত চরম সাজা প্রাপ্তদেরও বেকসুর খালাস করে দিয়েছে। বাথে গণহত্যার রায়ের আগে বাথানিটোলা, নাগরি এবং মিয়াপুরের দলিত গণহত্যা সংক্রান্ত তিনটি মামলার রায়ে এরকম অদ্ভুত প্রহসন লক্ষ্য করা গেছে।
১৯৯৬ এ সংগঠিত বাথানিটোলা গণহত্যার রায় দিতে গিয়ে ১৭ এপ্রিল ২০১২ পাটনা হাইকোর্ট নিম্ন আদালতে সাজা পাওয়া রণবীর সেনার ২৩ জন অপরাধীকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য বাথানিটোলার ঘটনায় ২১ জন দলিতকে হত্যার দায়ে নিম্ন আদালত এই ২৩ জনের মধ্যে ৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ২০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল।
২০১৩ র ১লা মার্চ পাটনা হাইকোর্ট ১৯৯৮ এর নাগরি গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত ১১ জনকেই বেকসুর খালাস করে দিয়েছে। নাগরি গণহত্যার ঘটনায় রণবীর সেনা ১০ জনকে গুলি করে হত্যা করেছিল, এদের মধ্যে ৩ জনকে নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড ও ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল। ২০১৩ সালের ৩ জুলাই মিয়াপুর গণহত্যার রায় দিতে গিয়ে পাটনা হাইকোর্ট নিম্নতর আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তিপ্রাপ্ত ১০ জনের ৯ জনকেই বেকসুর খালাস করে দিয়েছিল। ২০০০ সালে সংগঠিত এই গণহত্যায় ৩২ জন দলিতকে খুন করে রণবীর সেনার লোকজন।
১৯৯৭ এর শেষ রাতে গোটা দেশ যখন নতুন বছর পালনের প্রস্তুতিতে মাতোয়ারা, রণবীর সেনা জাহানাবাদ জেলার লখিমপুর বাথে গ্রামে প্রায় ষাট জনকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করে। শোন নদীর দু ধারের দুই এলাকা, বাথানি এবং বাথে জাতীয় খবর হয়ে ওঠে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণন বাথানিটোলার ঘটনাকে ‘জাতীয় লজ্জা’ বলে বর্ণনা করেন। গোটা দেশ জোড়া গণতান্ত্রিক কন্ঠস্বরের চাপে বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ বাধ্য হন রণবীর সেনার পেছনে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক মদতের অনুসন্ধানের জন্য আমীর দাস কমিশন তৈরি করতে। কিন্তু প্রথম থেকেই এই কমিশনকে পঙ্গু করে দেবার চেষ্টা চলে। কমিশন অভিযোগ করে তার কাছে যথেষ্ট অর্থ, কর্মী বা ক্ষমতা নেই।
এর মধ্যে সি পি আই (এম এল) লিবারেশন সহ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির ধারাবাহিক ও বহুমাত্রিক উদ্যোগ চলছিল উচ্চবর্ণের এই সশস্ত্র সংগঠনগুলির বিরুদ্ধে।  ২০০২ সালে অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রণবীর সেনা-র প্রধান ব্রহ্মেশ্বর সিং বিহার সরকারের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’ করে। ২০০৫ সালে বিহারে রাজনৈতিক পরিবর্তন হয় এবং বিজেপির সমর্থন নিয়ে জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) নেতা নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হন। সরকারের প্রথম সিদ্ধান্তগুলির অন্যতম ছিল আমীর দাস কমিশনকে বাতিল করা। জেডিইউ, বিজেপি নেতাদের অনেকেই, এমনকি আরজেডি বা কংগ্রেসের অনেক নেতাও এতে গভীর স্বস্তি পায়, কারণ তদন্তের জন্য এই কমিশন তাদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। এই জেডিইউ-বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় দফার সূচনাতেই জামিন পেয়ে যান ব্রহ্মেশ্বর সিং। কিন্তু জেল থেকে বেরোনোর পরই খুন হয়ে যান। তারপর ২০১২ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর ২০১৩ পর্যন্ত চলছে দলিত গণহত্যায় অভিযুক্ত, নিম্ন আদালতে প্রায় সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্তদের উচ্চ আদালতে একের পর এক বেকসুর খালাস।
বাথানিটোলা বাথে সহ নব্বই দশক জুড়ে বিহারে একের পর এক দলিত গণহত্যা যেমন লালু জমানার সমাজ রাজনৈতিক চরিত্রকে উন্মোচিত করে দিয়েছিল, তেমনি এপ্রিল ২০১২ থেকে অক্টোবর ২০১৩ পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে আসা হাইকোর্টের চারটি রায় — নীতীশ কুমারের বিহারের সমাজ রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রকট আয়না হয়ে উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্থদের ন্যায়বিচারের স্বার্থে হাইকোর্টের রায়কে সুপ্রিম কোর্টের পুনর্বিচার করা দরকার।
বিহারে রাজনৈতিক ক্ষমতার ইতিহাসে উচ্চবর্ণের জগন্নাথ মিশ্র আর বিন্দেশ্বরী দুবেদের থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে অনুচ্চ বর্ণের লালুপ্রসাদ নীতীশ কুমারদের হাতে। কিন্তু বাথানি, বাথে প্রভৃতি গণহত্যা এবং সেখানকার বিচারব্যবস্থার স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো রায় দেখিয়ে দেয়, রাষ্ট্র ক্ষমতায় সামন্ততান্ত্রিক শক্তিগুলির শেকড় কত গভীর। লালু প্রসাদ, নীতিশ কুমারের ‘সামাজিক ন্যায়’ বা ‘সুশাসন’ এর আড়ালে বিশ্বায়ন বা কর্পোরেটকরণের চকচকে পালিশে তার কতটা পরিবর্তন হয়েছে, সে প্রশ্নও উঠে যাচ্ছে।
বাথানি, বাথের ঘটনার পরিণতিতে অজানা, অশ্রুত, দরিদ্রতম কৃষকের ন্যায়বিচারের চাহিদা বিহারের বর্তমান শাসকদের রাজনৈতিক সঙ্কটকে যেমন প্রকট করছে, তেমনি নয়া বাতাসের আহ্বানও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।