- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

তেহট্টে পাকা বাড়ি বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইঁটভাটা

২৮ মার্চ, অমিতাভ সেন, তেহট্ট, নদীয়া#

নদীয়া জেলার তেহট্ট মহকুমার কাঁচা বাড়ির ছবি পত্রিকার নিজস্ব।
নদীয়া জেলার তেহট্ট মহকুমার কাঁচা বাড়ির ছবি পত্রিকার নিজস্ব।

তিন বছর পরে এসে দেখি রাস্তার ধারে মাটির বাড়ি প্রায় নেই। পাকা রাস্তা — মানে যেখানে পিচ পড়েছে, আর ঢালাই রাস্তা যেখানে পিচ পড়বে সেসব রাস্তার ধারে তো বটেই, অলিগলির মধ্যেও প্রচুর একতলা ইঁটের বাড়ি। নদীর ধারে আগে জেলখানা তৈরি হয়েছে তেহট্টকে মহকুমা শহর ঘোষণার পরে। এবার জেলখানার থেকে নদীর দিকে আরেকটু এগিয়ে কলেজের বিল্ডিং উঠছে — দু-দুটো কলেজ — একটা এমনি কলেজ, একটা আইটিআই। এরই মাঝমাঝি জায়গা দিয়ে পাকা সেতু তৈ হবে ওপারে যাওয়ার। ওপারের চকবিহারীতে তারই প্রস্তুতি চলছে — ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে নদীর ধার বরাবর মাটি কেটে রাস্তা তৈরি হচ্ছে।
চাষের কাজে আর তত লাভ নেই বলে, এখানকার বহু ছোটো চাষির ঘরের ছেলেরা অনেক আগে থেকেই কেউ কেউ পুণে-দিল্লি কাজের খোঁজে চলে যেত, এখন সেইসব ছেলেদের এক একজন লেবার কনট্রাক্টর, নিজেরা আর কাজ করে না, এখান থেকে ৬০-৭০ জনকে লেবার হিসাবে নিয়ে যায়। এই লেবারদের বেশিভাগেরই তেহট্টে নিজেদের চাষের জমি নেই। এরা যেমন রাজমিস্ত্রির কাজ করে, আবার অন্য কাজও করে — সব বলে না, যেমন কারো বউ হয়তো দু-তিন বা ঠিকে ঝিয়ের কাজ করে — তাদের পরিবার বলে, ওরা সব কাজ করতে বিদেশ গেছে। যাই  হোক বাইরের কাজে হাতে যে টাকাটা আসে, গ্রামে চাষের কাজের আয় থেকে তা অনেকটা বেশি। তাতেই, ওইসব কাঁচা বা (মাটির বা) ভেঙে, পাকাবাড়ি উঠছে। আর যে লেবার কনট্রাক্টর তার বা উঠছে পাক্কা দুতলা।
পাকা বাড়ি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাল দিয়ে বেড়েছে ইঁটভাটা — জলঙ্গী নদীর পার বরাবর গড়ে ওঠা ইঁটভাটা আধমরা নদীটাকে আরও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এ নিয়ে ভাববার অবকাশ তাদের নেই, যারা বাইরে থেকে হোক বা ভিতর থেকে হোক হাতে সদ্য কাঁচা টাকা পেয়ে গেছে। তাদের এখন মোটর বাইক কিনতে হবে। পাকা রাস্তার উপর দিয়ে লাল ধুলো উড়িয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মোটর বাইক চলে যাচ্ছে সাইকেল আরোহীদের তুচ্ছ করে। আর আসছে ধুলো উড়িয়ে স্থানীয় মানুষের ভাষায় পাঞ্জাব থেকে আনা ট্রাক্টর গাড়ি — যে গাড়িতে একদিকে খেতের গম কেটে অন্যদিকে ফসল ঝেড়ে দিচ্ছে মেশিনে।
মোটর বাইক বেড়ে যাওয়ায় খুব সমস্যা হচ্ছে হাঁটতে — একথা বলায় বাজারে ধুলোদার চায়ের দোকানে একজন বলল, ছোঁড়াগুলো চালাতে জানে না, যে কোনো দিক দিয়ে ঢুকে পড়ে — এটাই বড়ো মুশকিল। প্রচুর নতুন-দোকান উঠেছে, উঠছে যেদিকে কলেজ হবে সেই দিকে, আর সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো পোলট্রির ঘর — মুরগি চাষের টিনের শেড জালের দেওয়াল, গাছপালা-মাঠ সাফ করে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে জনপদ। তাতে এলাকার লোকজনকে খুশিখুশিই মনে হল — অনেক বেকার ছেলে ব্যবসা করে খেতে পারবে। শুধু এক গৃহবধু বলেছে, ছেলেদের খেলার মাঠটা কলেজের জন্য চলে গেল। সেও বেশি আক্ষেপের সঙ্গে নয়। তাছাড়া সন্ধ্যের আড্ডায় বাজারে-দোকানে কান পাতলে — শোনা যায় — তাপস পালটা কোনো কাজের নয়, আর কংগ্রেস-বিজেপি-তৃণমূলের ভোটকাটাকাটিতে সিপিএম বেরিয়ে যেতে পারে, অথবা টিভিতে দেখা বাপ্পি লাহিড়ীর সভায় বিশাল ভিড়ের বর্ণনা।
মাঠ-জঙ্গল সাফ-সুতরো হওয়ায় বেশ কিছুদিন ধরেই শিয়ালগুলো পাড়ার মধ্যে বাড়ির হাতায় ঢুকে আসছিল। এবার তাদেরকে দেখা গেল চণ্ডীমণ্ডপের পাশ দিয়ে বেরিয়ে পাকা রাস্তা পেরিয়ে সন্ধ্যেবেলা বাগানের দিকে চলে যেতে। রাতে তাদের ডাকও শোনা গেল, অবনীন্দ্রনাথের গল্পের মতো ‘হুয়া হুয়া, হুত্যা হুয়া’ বলে ডাকছে।