- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

তৃণমূল এবং ‘তৃণমূল’

গ্রামপ্রধান ভারতবর্ষে সমাজের তৃণমূল স্তরের অধিকাংশ মানুষ থাকে গ্রামে। তাই গ্রামপঞ্চায়েতকে ধরে নেওয়া হয় তৃণমূল স্তরের মানুষের একটা প্ল্যাটফর্ম। গ্রামপঞ্চায়েত সদস্যকে মনে করা হয় সমাজের তৃণমূল স্তরের একজন প্রতিনিধি। গ্রামপঞ্চায়েতের ওপর থাকে পঞ্চায়েত সমিতি, তার ওপরে জেলা পরিষদ। ধাপে ধাপে এই পথ বেয়ে গ্রামের সঙ্গে সরকারের আঁতাত গড়ে ওঠেছে। এই পথে রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতির মধ্যে টেনে আনা হয়েছে গ্রামকে, তৃণমূল স্তরের মানুষকে।
কিন্তু সমাজের তৃণমূল স্তরের মানুষ কি নিজেদের ভালোমন্দ নিয়ে সচ্ছন্দে কথা বলতে পারে গ্রামপঞ্চায়েতে? নিজেদের চাষের সমস্যা, জলের সমস্যা, রুজি-রোজগারের সমস্যা এবং সকলে মিলেমিশে বাঁচা নিয়ে কি এই প্ল্যাটফর্মে তারা কথা বলতে পারে?
আগের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর আমি দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটা গ্রামে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার বন্ধু আমাকে নিয়ে গেলেন এক মহিলা গ্রামপঞ্চায়েত সদস্যার বাড়িতে। স্বামী-স্ত্রী অন্যের কাছ থেকে জমি নিয়ে চাষ করেন, নিজেদের জমিজমা নেই, মাঠে লেবারের কাজও করেন। এই মহিলা পার্টি-ফাটি তেমন বোঝেন না। স্বামী পার্টি করেন, সেই সুবাদে তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছিল। এমনকী গ্রামপঞ্চায়েতে গ্রামসভা নামে যে একটা ব্যাপার আছে, যেখানে সাধারণ গ্রামবাসী মতবিনিময় করতে পারে, সেটা আদৌ জানেন না। গ্রামপঞ্চায়েত মানে তিনি বোঝেন, কার বাড়ির সামনে একটা কল বসবে, কোথায় একটা ইলেকট্রিক পোস্ট বসবে, কোথায় একটা রাস্তা হবে ইত্যাদি। এককথায় এগুলোকে বলা হয় ‘উন্নয়ন’। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিপিএল কার্ড আর একশো দিনের কাজের বিলিবন্টন।
একসময় গ্রামপঞ্চায়েত বলতে বোঝাত বামফ্রন্টের ক্ষমতা। শ্রমজীবী, চাষি এবং নিপীড়িত মানুষের প্রতিনিধি ছিল বামপন্থী দল। তাদেরকেই গ্রামাঞ্চলের তৃণমূল স্তরের মানুষের কথা বলবার যোগ্য বলে ধরে নেওয়া হত। কিন্তু দিনে দিনে টের পাওয়া গেল তৃণমূল স্তরের মানুষের কোনো প্রতিনিধি নেই। ২০০৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে রেশন-বিদ্রোহের সময় এটা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল। সমস্ত দলকে বাদ দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ওই বিদ্রোহ গড়ে উঠেছিল।
কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে ‘তৃণমূল’ দল গঠন হয়েছিল এই শূন্যতাকে পূরণ করার বাসনা থেকে। ‘তৃণমূল’ নামটাও বেছে নেওয়া হয়েছিল এই তৃণমূল স্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার বাসনা থেকেই। এবারের পঞ্চায়েত ভোটের ফলাফল দেখিয়ে দিচ্ছে, ‘তৃণমূল’-এর সেই বাসনা অনেকটাই পূরণ হয়েছে।
কিন্তু পঞ্চায়েত কি এতদিনেও তৃণমূল স্তরের মানুষের একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠতে পেরেছে? এই প্রশ্নের উত্তর তৃণমূল স্তরের মানুষের কাছ থেকেই পেতে হবে।