- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘ডাইনি’-র খোঁজে

শুভ প্রতিম, ১৪ আগস্ট#

ডাইনি আখ্যা পাওয়া পরিবারের প্রধান গোপাল মুর্মুর বাড়ির দেওয়াল। ছবি আমরা এক সচেতন প্রয়াসের ফেসবুক পেজ থেকে।
ডাইনি আখ্যা পাওয়া পরিবারের প্রধান গোপাল মুর্মুর বাড়ির দেওয়াল। ছবি আমরা এক সচেতন প্রয়াসের ফেসবুক পেজ থেকে।

সজনী হাঁসদাকে প্রথম দেখি তার দিদির সাথে, আমাদের নিতে এসেছিলেন ব্যান্ডেল থেকে পোলবা যাবার তেমাথার মোড়ে।তার নিকষ কালো চোখের তারা যেন বলতে চাইছিল অনেক কিছু,তখনই। ব্যান্ডেল রেল কলোনির একটি কোয়াটারে তাঁদের আপাত নিবাস, অনিশ্চিত, আতঙ্কিত জীবন যাপন। কবে কখন তারা আবার বাড়ি ফিরবে জানা নেই। জানা নেই আদৌ ফেরা যাবে কিনা তার আভাস।যদিও আভাষ আমরা পেয়েছিলাম পোলবা থানায়, যখন ও সি অসিত দাস জানান তদন্ত কতদূর বা কেন কেও এখনও গ্রেপ্তার হল না সেসব বলা যাবে না।

আমরা এক সচেতন প্রয়াস’এর পক্ষ থেকে গত ১২ জুলাই ২০১৩ আমরা হুগলী জেলার পোলবা থানার একটি গ্রামে কথিত ডাইনির খোঁজে যাত্রা শুরু করি। কয়েক পর্যায়ে চলে সেই তথ্যায়ণ, জানগুরু-‘ডাইনি’গ্রামের মানুষ, কথা হয় অনেকের সাথে।দ্বিতীয় পর্যায়ে আমাদের যাওয়া গত ১৮ জুলাই।যারা এই প্রয়াসে যুক্ত হন তারা হলেন সাধন বিশ্বাস, অনুপম দাস অধিকারি, ফারুক উল ইসলাম, অলক দত্ত,উদায়াদিত্য ভট্টাচার্য, শুভপ্রতিম রায়চৌধুরী। এখানে আমাদের প্রথম পর্বের বর্ণনা রাখা হল।

সজনী থাকেন পোলবা থানার একটি গ্রামে, গ্রামের নাম রহীমপুর, গ্রাম পঞ্চায়েত মহানাদ। রহীমপুরে তার বাবার বাড়ি। তার বয়ানে যা জানা গেল২০ জুন রাত্রি ১১ টা, খাওয়া দাওয়া করে সকলে শুয়ে পরেছি তখন। বাবা (গোপাল মুরমু) একটু লেটে শুতে যায় টিভি দেখে। সেদিনও তাই, টিভি বন্ধ করে যখন বাথরুমে যাবেন দেখেন বাইরে কয়েকজন ঘোরাফেরা করছে। বাবা জানতে চান এত রাত্রে এখানে কি করছ? তারা বলে পুকুরে মাছ দেখছি।রাত্রি সাড়ে এগারোটা নাগাদ একদল লোক দরজা ধাক্কা দেয়,বলে এখানে পুজোআচ্ছা হচ্ছে। অথচ আমরা তখন শুয়ে পরেছি। ওরা সবাই এসেছিল দক্ষিণ পাড়া থেকে। দরজা ভেঙ্গে যারা ঢোকে তারা কেও সাঁওতাল নয়। সবাই বাঙ্গালি,জাতিতে জেলে,বাগদি, বাঙাল। যদিও সাঁওতালদের সমর্থন না থাকলে এ ঘটনা হয় না। ওরা প্রায় ৩০৩৫ জন হবে, চিৎকার করে বলতে থাকে, একটা বাচ্চা ছেলেকে ডাইনীবিদ্যায় আসুস্থ করে রেখেছিস, ওখানে চল।আমার বাবা বাধা দিতে গেলে, তাকে সজোরে আঘাত করে, বাবার মাথা ফেটে যায়।ভয়ে আমার বৌদি তার ১০ মাসের বাচ্চাকে নিয়ে খাটের তলায় ঢুকে পড়ে, ওরা ওইটুকু বাচ্চাকেও রেহাই দেয়নি।(পোলবা থানার অদূরে যে আত্মীয়ের বাড়িতে গোপাল মুরমু পরিবার নিয়ে বর্তমানে থাকেন, সেখানে আহত শিশুটিকে আমরা দেখি, দেখি রক্তাক্ত গোপাল মুরমুর ছবি)

গোপাল বাবু কাজ করেন কলকাতা কর্পোরেশনে,গ্রুপ ফোর স্টাফ। আমরা তার সাথে কথা বলি কলকাতায়। তিনি বলেন,বছর কুড়ি আগের কথা,গ্রামে তখন রামদাস মুরমু ছিল মোড়ল, আমার বুড়ি মাকে ওরা ‘ডাইনি’ বলল। জরিমানা ধার্য হল দশ হাজার টাকা। আমরা তখন খুব গরীব, জরিমানা দেবার ক্ষমতা কোথায়। এই অপবাদের কয়েকদিন পরে আমার মা সারা গ্রামের ‘এই ডাইনি বুড়ি’ শুনতে শুনতে মনকষ্টে মারা যান। জরিমানা দিতে না পারায় আমাদের গ্রামের বাইরে বের করা হল, তখন থেকে আমরা মোড়লের শাসনের বাইরে। বছর আটেক আগে আমাদের পাড়ার কয়েকজন (নিখিল সরেন, বৈদ্যনাথ মুরমু, নির্মল সরেন) হটাৎ আমাদের কিছু না জানিয়ে আমাদের বাড়ির অদূরে ক্লাব তৈরি করতে শুরু করে। আমার জমির কিছু অংশ তাতে ঢোকানো হয়। ক্লাবএর নাম রহীমপুর গাঁতে গাওতা। বাধা দিই আমি,দরখাস্ত করি তখনকার প্রধানের কাছে, শেষে তাঁর হস্তক্ষেপে ক্লাব তৈরি বন্ধ থাকে। সাঁওতাল সমাজের কাছে আমরা এমনিতেই সমাজচ্যুত, এ ঘটনার পড়ে আমরা আরও একঘরে হয়ে যায়। ইতি মধ্যে আমি চাকরি পাওয়াতে সচ্ছলতা আসে সংসারে। কিছু ধান জমি কিনি। বিভিন্ন সময়ে আদিবাসি সমাজের কুপ্রথার বিরুদ্ধেও বলতে থাকি, এই প্রথা আমার মা’কে কেড়ে নিয়েছে। ওদের রাগ বাড়তে থাকে। রাজকবি মুরমু বিত্তবান লোক, তার নজরে আমার সম্পত্তি। শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়াতে অসীম ক্ষমতাধর। সমাজের বর্তমান মোড়ল লক্ষণ মুরমুরও বিষ নজরে আমার পরিবার।

ঘটনার দিন রাত্রে গোপাল মুরমুর বড় ছেলে গোবিন্দ বাড়িতে ছিলেন না, কর্মসূত্রে চেন্নাইএ ছিলেন। স্ত্রীর ফোনে সব জানতে পেরে তিনিই প্রথম চেন্নাই থেকে পোলবা থানায় ফোন করেন। পোলবার সিঙ্গি পাড়ায় আত্মীয়, গুরুচরণ হেম্ব্রমের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন তাঁরা। ঘটনার পর থেকে গোবিন্দ ফিরে এসেছেন, আছেন পরিবারের সাথে। তিনি বলেন, আমি ফোন করা স্বত্বেও পুলিশ সঙ্গে সঙ্গে রওনা দেয়নি, তারা পৌছয় যখন, ততক্ষণে ওরা সজনীকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। সজনীর স্বামী কোনক্রমে পালিয়ে গিয়ে খবর দেয় পুলিশকে। ঘটনার পরদিন (২১ জুন ২০১৩)একটি সাধারণ ডায়রি করা হয়, যাতে ঘটনাকে লঘু দেখানোর চেষ্টা থাকে। ইতিমধ্যে কয়েকটি বড় মিডিয়াতে আমাদের ঘটনাটি খবর হয়।৫ জুলাই ২০১৩ তারিখে রাত্রি ১১টায় পোলবা থানার বড় বাবু, আসিত দাস ডাক দেন, বলেন এফ আই আর নেওয়া হবে। জায়গা কম বলে অভিযোগ সংক্ষিপ্ত করতে বলেন। ওত রাত্রে স্বাভাবিকভাবেই আমার বাবা খুব চাপে ছিলেন, বড়বাবুর কথামত যে এফ আই আর করা হয় তাতে আমাদের দাবি স্পষ্ট হয়না।

সজনীকে প্রায় অর্ধনগ্ন করে রাজকুমার বৈদ্যর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ যখন তাকে উদ্ধার করে তখন তার পড়নে ছিল ছেঁড়া কাপড়। সে রাত্রির কথা বলতে এখনও শিউরে ওঠেন সজনী। বলেন, আমার তুত দিদি হাঁসি হাঁসদা আমাদের বাড়িতে ছিল,তাকেও চুলের মুঠি ধরে মাটিতে আছাড় মারে,ইট দিয়ে ডান পায়ের পাতায় সপাটে মারে। আমার বৌদি পূর্ণিমা মুরমুকে তার কোলে থাকা ১০ দিনের বাচ্চা সহ খাটের তলা থেকে হিড়হিড় টেনে আনে, বাচ্চাটাকেও রেহাই দেইনি ওরা। সজনী বলেন, সবাইকে ঠিক চিনতে পারিনি, তবে যে কজনকে চিনেছি তারা হল, কার্ত্তিক রায়,শিবনাথ পাত্র,স্বাপন বিশ্বাস,মিঠুন বিশ্বাস,রাজকুমার বৈদ্য,দুলাল সারকার,রুইদাস সরকার,অনিল রায়, অনন্ত মালিক ইত্যাদি। ওরা আমাকে মারতে মারতে নিয়ে যায়। আমি বলি, আমার কি দোষ বল, ওরা কোন কথা শোনেনা। ৭৮ বছরের বাচ্চা রাজীব বৈদ্য, তাকে দেখিনি কখনও, ওরা বলল, ওকে তুই অসুস্থ করে রেখেছিস, ভাল কর। আমি বলি, ডাক্তার দেখাও,শুনে ওরা আবার লাঠি তোলে। আমার বাবা বলে, আমার মেয়েকে মেরো না। আমি বলি, আমাদের জ্বালিয়ে মেরে ফেলো, আমাদের কিছু করার নেই। আমাদের সামনে এক রোজা বসেছিল, নাম সম্ভবত মুঙ্গুল, শুনেছি খন্যানের ইটাচুনা কলেজের কাছে থাকে। সে বলে, বাচ্চাটা নাকি আমার নাম বলেছে। আমি বলি, তাই যদি হয়, তবে বলুক আমার বাড়ি কোথায়, কিরকম দেখতে আমার বাড়ি। কিছু বলেনা বাচ্চাটা। দেরিতে হলেও পুলিশ না পৌঁছলে যে কি হত জানিনা। মেরেই ফেলত আমাদের।

১২ জুলাই প্রথমে আমরা পোলবা থানায় যায় ঘটনার বিষয়ে জানতে, ও সি আসিত দাস তখন থানায় নেই, উপস্থিত অফিসার বড়বাবু ছাড়া কিছু বলা যাবেনা, একথা জানান। আমরা তাঁর কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে বড়বাবুর সাথে ফোনে কথা বলি। তিনি বলেন, তদন্ত চলছে,এখনই কিছু বলা যাবে না। জানতে চাওয়া হয়, এখনও কাওকে গ্রেফতার করা হল না কেন? উনি বলেন, এ বিষয়েও কিছু বলা যাবে না। গোপাল মুরমুর পরিবার এখন কোথায় তা জানতে চাইলে বলেন আমি জানিনা।

পরে আমরা গোপাল বাবু ও তাঁর ছেলে গোবিন্দর কাছে জানতে পারি, তাঁরা বড়বাবুকে বারংবার অনুরোধ করেছেন বাড়িতে ফেলে আসা ধান,চাল,খাদ্যদ্রব্য ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে। আলমারি, ৫০ বস্তা ধান, নগদ টাকা লুঠ হয়েছে তাঁদের, ফিরে পেয়েছেন শুধু ১ বস্তা ধান। বড়বাবু উল্টে বলছেন, কাওকে গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া কি আমাদের দায়িত্ব? এও বলেন, কেন আপনারা পুজোআচ্ছা করেন? মানে কিনা আমরা পুজো করেই বাচ্চাটাকে মেরে ফেলছিলাম। আমাদের বাড়িতে রাধাকৃষ্ণ, শিব পুজো হয়, বলুন তা কি অপরাধ? উত্তর দিতে পারিনি আমরা। গ্রামে তাঁদের জমি, বাড়ির ওপর নজর আছে প্রতিবেশী সাঁওতাল বাঙালি সকলের। তাঁরা চলে আসার পর তাঁর বাড়িতে লেখা হয়েছে, গোপালের পরিবারকে আর কোনদিন গ্রামে ফিরতে দেওয়া হবে না তার হুমকি।তার জমিতে চাষ করতে না দেবার ফতোয়া। পাড়ায় পাড়ায় গণ সাক্ষর নেবার পর্ব চলছে। সংখ্যায় কম হলেও কয়েক জন সই করতে চাইনি। তাদেরও গ্রাম থেকে তাড়ানোর হুমকি দেওয়া চলছে।

প্রশ্ন করেছিলাম গ্রামে কি ফিরতে চান আপনারা? অবরুদ্ধ কান্না আটকে উত্তর দেন সজনী, না, ওখানে ফিরলে বাঁচব না আমরা। ২০ বছর পড়েও আমার ঠাকুমার ঘটনা ফিরে এসেছে আবার, এবার আমি। এর পর অন্য কেও। আমার দিদির ছোট্ট মেয়েটা আমার বাবার কাছেই থাকত, ওখান থেকেই ইশকুলে যেত সে। হটাৎ রোগে ভুগে মারা যায় সে। গ্রামের কেও আমাদের পাশে দাঁড়ায় না, শেষকৃত্য করতে আসেনা কেও। ওই টুকু বাচ্চাকেও ওরা মায়া করেনি। আমরা আর ওখানে ফিরব না।দিনের পর দিন আমরা বাড়ি,জমি থেকে উৎখাত হয়ে রয়েছি অন্যের বাড়িতে। আপনারাই বলুন কোথায় যাব আমরা?

এর উত্তর আমাদেরও জানা নেই।