- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘জেলের মধ্যে পুলিশের ব্যবস্থাপনা থাকলেও প্রকৃত অর্থে জেল চালায় কয়েদিরাই’

২০ জুন ২০১২ নোনাডাঙার বস্তি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে ধর্মতলায় প্রতিবাদে শামিল আন্দোলনকারীদের প্রথমে গ্রেপ্তার, পরে পুলিশ হেফাজত ও জেল হেফাজতে থাকার সময়ে জেলের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে জেলের অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছেন রঞ্জন। এবার দ্বিতীয় কিস্তি#

লালবাজার লকআপে দিনে দুবার খাবার দেওয়া হত। সকালে সাড়ে আটটার সময় আর রাতে সাড়ে আটটায়। এর মাঝে বারো ঘণ্টা কোনো খাবার দেওয়া হয় না। জেলে সকালে দুটো বিস্কুট আর চা দেওয়া হত, আর সন্ধ্যেবেলা দুটো বিস্কুট আর চা দেওয়া হত। কেউ কেউ রাতে ভাতের বদলে রুটি নিলে তার থেকে রুটি রেখে দিত সকালের জন্য। প্রথম কয়েকদিন এভাবে চলার পর আমরা সকলে মিলে দাবিদাওয়া করলে সকালে দুটোর বদলে আমাদের ছ-টা বিস্কুট দেওয়া হল। এখানে হঠাৎ কীভাবে বিস্কুটের বরাদ্দ বাড়ানো হল তা আমাদের জানা ছিল না, আর অন্যান্য কয়েদীদের জন্যও সেই বরাদ্দ বেড়েছিল কিনা তাও আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হয়নি।
লকআপে নিয়মিত কয়েদিদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে, তবে তা নামে মাত্রই। ডাক্তারদের সকলকে দেখে MBBS পাশ করা বলে মনে হয়নি। জেলের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে তার জন্য ওষুধপত্রের বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই, এ ব্যাপারে ডাক্তারদের কাছে জানতে চাইলে তাঁরা বলেন তাঁদের কিছু করার নেই।

লালবাজারে জেরার দিনগুলি 
ধর্মতলা থেকে ধরা নোনাডাঙার উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনকারীদেরকে জেরা করত STF এর অফিসাররা। জেরার ধরনটা ছিল এমন যেন তারা ভারতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে এবং অবশ্যই তা মাওবাদী মদতে। আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রদ্রোহিতার কাজ করছে। সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনকে সরকার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসাবেই দেখছে। অথচ লালবাজারে পুলিশকর্মীদের মধ্যে থেকেই কয়েকজনকে বলতে শোনা গেছে, গণআন্দোলনের কর্মীদের এইভাবে দীর্ঘদিন আটকে রাখার কোনো নজির আগে ছিল না।
জেরার সময়ে প্রশ্নের ধরন ছিল — মাওবাদী নামে পরিচিত কয়েকজনকে আমরা চিনি কিনা? তারা কোথা থেকে আসে, আমরা তাদের চিনলাম কী করে, মাওবাদীদের মধ্যে কারা আসে, এই বলে কয়েকজনের ফটো দেখিয়ে আমাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় আমরা তাদের চিনি কিনা। বস্তিতে বসবাসকারীদেরকে বারবার জবরদখলকারী রূপে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ বর্তমান সরকার শহর গ্রামের গড়ে ওঠার ইতিহাসকেই অস্বীকার করছে। গ্রাম থেকে শহরে কায়িক শ্রমের কাজে দিনমজুর মানুষ হল শহরের উৎপাত, এ কথাটাই যেন বিভিন্নভাবে পুলিশের জেরার হাবেভাবে উঠে আসছিল।
জেরার সময় জানতে চাওয়া হয়েছিল এই যে এখানে কমন রান্নাঘর রয়েছে, প্রতিদিন তার প্রয়োজনীয় রসদ কোথা থেকে আসছে, কোনো বিদেশি তহবিল এর পিছনে আছে কিনা? এই সময় সকলের সিআরএস (ক্রিমিনাল রেকর্ড) রেকর্ড করা হয়। জেরার সময় কম বয়সিদেরকে প্রায়শই ভয় দেখানো হত। তাদের ওপর মানসিক চাপ বাড়িয়ে তাদেরকে ভীত সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা চলত অনবরত। লালবাজারের থাকাকালীন পুলিশ মোটামুটিভাবে আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করেছিল, তারাও বুঝতে পারছিল না এইভাবে আমাদের আটকে রাখার পিছনে কী যুক্তি থাকতে পারে।
কোর্টের লকআপে সারাদিন 
আদালতে যেদিন আমাদের ডাক পড়ত সেদিন সারাদিন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের লকআপে আমাদের থাকতে হত। সেদিনটা সকল কয়েদিদের জন্যই ছিল ভয়ঙ্কর দিন। কোর্টের লকআপের জায়গাটি ছিল অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। খোলা বাথরুম, তার পাশেই লকআপ, ঘন্টার পর ঘন্টা সেখানে কয়েদিদের দাঁড় করিয়ে রাখা হত। সাধারণত বাড়ির লোকজনকে সেখানে ঢুকতে দেওয়া বা কোনো বাইরের খাবার দাবার সেখানে দিতে দেওয়া হত না। তবে বড়ো বড়ো খুনি আসামীদের জন্য নিয়মের বদল হতে দেখা যায়। পুলিশের সাথে তাদের অন্য বোঝাপড়া থাকায় তারা সবরকম সুবিধা পেত। কোর্টে সারাদিন থাকাকালীন জল তেষ্টা পেলে বাথরুম লাগোয়া একটি ট্যাপ কল দেখিয়ে দেওয়া হত। সেটা আদৌ খাবার জলের কল কিনা দেখে সন্দেহ হত।
আদালতে ৩০ জুন আমাদের জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়। যদিও আমাদের বিরুদ্ধে আনা অস্ত্র জড়ো করা বা পুলিশের ওপর হামলা করার কোনো অভিযোগই প্রমাণিত হয়নি। এর সাথে বিনা অপরাধে সুনীল কুমার গুপ্তারও একই সাজা হয়। আন্দোলনকারীদের সাথে তাকেও সমানভাবে বন্দি জীবন কাটাতে হয়। প্রত্যেকবার তার জন্য আলাদা করে উকিল দাঁড়ালেও তার কথার কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয় না এবং পুলিশের তরফেও তার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। আর সরকারের উকিল বিচারকদের তো কোনো ইচ্ছাই নেই প্রকৃত তথ্য জানতে চাওয়ার। না হলে এর আগে নোনাডাঙায় প্রতিবাদী বস্তিবাসীদের গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুবার পুলিশ কাস্টডি দেওয়ার পরও পুলিশ কোনো প্রমাণ না দিতে পারা সত্ত্বেও পুলিশের মিথ্যা অভিযোগের ভিত্তিতে আটক এই দিনমজুর বস্তিবাসীদের বিচারক ৫০০০ টাকা আর্থিক জরিমানার ভিত্তিতে জামিনের নির্দেশ দেন। বস্তিবাদীদের পক্ষে সওয়াল করতে ওঠা উকিল বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও, এমনকী সচক্ষে তাদের চেহারা দেখে, তাদের অবস্থা বুঝে এই জরিমানা মকুবের কথা বললেও বিচারক তাতে কর্ণপাত করেননি।

প্রেসিডেন্সি জেলের আমদানি ঘরে প্রথম রাত 
৩০ জুন প্রায় বিকেল ৫টা নাগাদ আমাদের প্রেসিডেন্সি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সারাদিনের ক্লান্তি ও অবসাদের পর সেখানে পৌছে জানতে পারি আমাদের জন্য কোনো কয়েদখানার ব্যবস্থা হয়নি, কারণ কোর্টের নির্দেশ জেল কর্তৃপক্ষ কাছে অনেক পরে এসেছে। আমাদের সেদিন তাই জেলের আমদানি ঘরে রাখা হয়। লালবাজার লকআপ থেকে এর প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ আলাদা। জেলের মধ্যে পুলিশের ব্যবস্থাপনা থাকলেও প্রকৃত অর্থে জেল চালায় কয়েদিরা। যারা মূলত যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী তাদের হাতেই থাকে জেলের ক্ষমতা। সাধারণত এদের ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত খারাপ। গোটা জেলের মধ্যেই ভাষার ব্যবহার বিশেষভাবে নজরে পড়ে। ‘তুই’ শব্দটি জেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলে। তুমি বা আপনি সম্বোধন এখানে চলে না। জেলের আমদানি ঘরে প্রথম রাতে কোনো শোবার ব্যবস্থা ছিল না, কারণ একটা ঘরে ছিল প্রায় দেড়শো জন। এর পর আমরা জানতে পারি আমাদের জন্য সেদিন রাতে কোনো খাবার ব্যবস্থাও ছিল না। কারণ কোর্টের নির্দেশ আসতে দেরি হওয়ায় রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়নি। আমাদানি ঘরের কয়েদিদের সর্দার মেহেরবান যাকে জেলের ভাষায় মেড বলা হয় সে আমাদের জন্য রাতে কিছু রুটির ব্যবস্থা করেছিল। পরে জেলার এসে আমাদের জন্য কিছু চিঁড়ে ও গুড় দিয়ে যান।
জেলের প্রথম রাতে আমদানি ঘরে সবচেয়ে সমস্যা ছিল খাবার জলের। শ’দেড়েক বন্দির জন্য কয়েকটা ড্রামে জল ভর্তি করে রাখা হত। এই জলই স্নান ও খাবারের জন্য ব্যবহৃত হত। শৌচালয়ের সংখ্যা চার হলেও তার সবগুলিতে জলের ব্যবস্থা ছিল না। এখানে বন্দি থাকা নাইজেরিয়ান বন্দিদের জন্য আলাদা দুটি বাথরুম ছিল, তাদের আলাদাভাবে খাওয়ার ব্যবস্থা হত। এদের কাছে বন্দিত্বের কারণ জানতে চাইলে এরা বলে পাসপোর্টের কারণে। সঠিক কারণ আমি বলতে পারব না। জেমস্‌ বলে একজনের সাথে আলাপ হয় যে আমাদের আন্দোলনের কথা জেনে সহানুভূতি জানিয়েছিল। ওরা প্রায় দেড় বছর ধরে এখানে রয়েছে। ওরা খুব ফুটবল খেলতে ভালবাসে এবং সবাইকে ফুটবল খেলতে উৎসাহ দেয়। চলবে

সংশোধনী : গত সংখ্যায় প্রকাশিত অংশে মন্ত্রীর সঙ্গে ধর্মতলায় অবস্থানকারীদের আলোচনার কথায় একটু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়েছে। ধর্মতলায় ধরনার দিন প্রথমে পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরাদ হাকিম উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে ২৬ জুন সাক্ষাতের লিখিত প্রতিশ্রুতি দেন। পরে তিনি সেই তারিখ বদলে ৩ জুলাই করার কথা বলেন। কিন্তু তিনি লিখিত আকারে সেই সাক্ষাতের সময় দিতে অস্বীকার করেন। — রঞ্জন।