- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

জানো তো, ওই পাশ-বালিশটাই আমার মা

অমিতা নন্দী, রবীন্দ্রনগর, মহেশতলা, ১২ অক্টোবর#

ভবানীপুরের ‘জগুবাজার’ বাসস্টপে বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ ২৪১এ বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। একই সঙ্গে অপেক্ষা করছে আরও বেশ কিছু মানুষ। একজন বয়স্কা মহিলা এবং একটি কিশোর যার হাতে-কাঁধে ক্রিকেট খেলার সরঞ্জামের দুটি বড়ো ব্যাগ — দুজনেই আমার মতো একই রুটের বাস ধরার অপেক্ষায়। সবাই কমবেশি অস্থির হয়ে উঠেছি। শুনলাম ওই মহিলা বিকেল পাঁচটা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ওদের জানালাম যে সকালে অফিসটাইমে যখন আমি আকড়া ফটক-রবীন্দ্রনগর থেকে ভবানীপুরে আসি, তখনও বাস অনেক বাদে বাদে আসছিল। কিছুদিন ধরেই বাস যে লক্ষণীয়ভাবে কম চলছে, এটা অনেকেই বুঝতে পারছে। কিশোর ছেলেটিকে বললাম, ‘বাবা, এরপর যে বাসটি আসবে তাতে এত ভিড় হবে যে তুমি বোধহয় এসব ঢাউস ব্যাগ নিয়ে উঠতে পারবে না। তুমি তো বললে জিনজিরা বাজার যাবে। এক কাজ করো, কোনো ফাঁকা বাস পেলে টালিগঞ্জ (চারুমার্কেট) স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে ব্রেসব্রিজ চলে যাও, ট্রেন তবু নির্দিষ্ট সময়ের কাছাকাছি পাবে’। ছেলেটি বলল, ‘এখন অফিসফেরতা ভিড়ের ট্রেনে আমাকে উঠতেই দেবে না। আমি বরং হাজরা চলে যাই, ওখান থেকে আরও কোনো বাস পেতে পারি’। সেই মতো সামনে যে ২১/১ আসছিল, ও তড়িঘড়ি তাতেই উঠে পড়ল, আমি আর বলে উঠতে পারলাম না যে, তাহলে একেবারে তারাতলায় গিয়ে নেমো। আর অবাক কাণ্ড, ঠিক তার পরের বাসটিই এল ২৪১এ এবং বেশ হালকা ভিড়। আমি এবং ওই মহিলা তো হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়লাম। উঠেই বাঁদিকে একটা সিটে ওঁকে বসিয়ে ড্রাইভারের কেবিনের পাশে একটু উঁচুতে আমিও বসার জায়গা পেলাম। তারপর দুজনেই আপশোষ করছি, আহা রে। ছেলেটাও এই বাসে অনায়াসে উঠতে পারত। কিন্তু আমরা তো কেউ গণৎকার নই, কী করে জানব তখনই ২৪১এ এসে পড়বে?
বাসটা যেই হাজরা মোড়ে এল, আমি জানলা দিয়ে বাসস্টপে ওই ছেলেটিকে আতিপাতি করে খুঁজতে খুঁজতে দেখতে পেলাম, হাত নাড়লাম। কিন্তু না, ততক্ষণে এত লোক উঠে পড়েছে যে ছেলেটি আর উঠতে পারল না। দেখলাম ও অটো ধরতে এগিয়ে গেল।
তারপরেই প্রচণ্ড চেঁচামেচি-কথা কাটাকাটির শব্দে বাসের ভিতর দৃষ্টি ফিরল। ড্রাইভারের কেবিনের কাছে ভিড়ের চাপে বেশ কসরৎ করে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে চাপ সামলাচ্ছেন। একটি বছর নয়-দশের বাচ্চাকে নিয়ে দুটি ব্যাগ সহ এক মহিলা উঠেই খুব চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছেন — আপনাদের কোনো আক্কেল নেই, বাচ্চাটাকে এগোতে দিন, সরে যান এখান থেকে … ইত্যাদি বলেই চলেছেন, উচ্চস্বরে। সবাই মিলে কিন্তু বাচ্চাটাকে দুটো ব্যাগ সহ ড্রাইভারের ইঞ্জিনের ওপরের সিটে বসার ব্যবস্থা করে দিল। যে লোকটিকে ওই মহিলা বকাবকি করছিলেন, তিনিও আর কোনো জবাব না দিয়ে হাত লাগালেন বাচ্চাটির জন্য। তারপরেও তার মা চেঁচাচ্ছেন দেখে আমি একটু ধমক দিয়ে দিলাম। একটু পরেই তিনিও ভালো সিট পেয়ে বসলেন। ছেলে কিন্তু ওই গরম সিটেই বসে থাকল।
ছেলে? হ্যাঁ, ওর পরনের স্কার্ট ও গেঞ্জি এবং চুলের ছাঁট দেখে সবাই হাফপ্যান্ট পরা ছেলেই ভেবেছি। তারপরই বুঝলাম একটা বাচ্চা মেয়ে। সে কিন্তু দিব্যি হাসিমুখে গল্প জুড়ে দিয়েছে আমার সঙ্গিনী ওই বয়স্কা মহিলার সঙ্গে। আমি ভাবলাম বুঝি চেনাজানা আছে। তার স্কুলের গল্প, খেলার গল্প, দিদিমণিদের গল্প, দিদিমণিদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে হাতে বল লেগে চোট পাওয়া এবং তারপর তাঁদের আদর-ভালোবাসা-যত্নের গল্প … সে কত কিছু। মুখে যেন তার খই ফুটছে। কোনো ক্লান্তি নেই, একটু দূর থেকে তার মা মাঝেমাঝে একটু চোখ পাকাচ্ছেন, এত ভিড়ে পাছে লোকে বিরক্ত হয় তাই ওকে একটু চুপ থাকতে বলছেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মুখে ব্যথা করছে না তো? ও ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলল। বললাম, তবে তুমি যত খুশি কথা বলো, আমাদের ভালোই লাগছে। ইতিমধ্যে দেখি আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা বেশকিছু লোকও সাগ্রহে ওর গল্প শোনার চেষ্টা করছে। কিছু পরে আমার পাশের আসন খালি হতেই ওকে বসালাম। তারপর আমিও গল্প জুড়লাম ওর সঙ্গে। জানলাম ওর কথা।
মেয়েটি এখন ক্লাস ফোরে পড়ে, হরিদেবপুরের একটি মিশনারি স্কুলে। ক্লাস ওয়ান থেকেই ওখানকার হস্টেলে থাকে। সপ্তাহে একবার বাড়ি আসে মা বা বাবার সঙ্গে। আর কোনো ভাই-বোন নেই। এখন পুজোর ছুটি পড়ে গেল — সেই নভেম্বরের মাঝামাঝি স্কুল খুলবে। তাই খুব আনন্দ হচ্ছে ওর। প্রশ্ন করি, তোমার ওখানে কোনো বন্ধু নেই? ওখানে থাকতে ভালো লাগে?
— হ্যাঁ, অনেক বন্ধু আছে। সবাই খুব ভালো। খালি মায়ের জন্য কষ্ট হয় মাঝেমাঝে। জানো তো আমার দুটো মাথার বালিশ আর একটা পাশ-বালিশ আছে। মায়ের কথা মনে পড়লে ওই পাশ-বালিশটা জড়িয়ে ধরে শুই। ওটাই তখন আমার মা।
দূর থেকে ওর মা তখন মিটিমিটি হাসছেন, আর আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। পাশের মহিলা বললেন, ‘এই মেয়েকে দূরে পাঠিয়ে মা কেমন করে থাকে? এত ছোটো বয়সে বাড়িতে রেখে কি কোনো ভালো স্কুলে পড়ানো যায় না? কে দেবে তার উত্তর?
তারপর সন্তোষপুর স্টেশন রোডে পাহাড়পুর ক্লাবের বাসস্টপ এল, ওদের নামতে হবে। সবাই মিলে হাতে হাতে ব্যাগপত্র সমেত ওদের নামতে সাহায্য করল। মেয়েটি হাসতে হাসতে বলল, এই ড্রাইভারকাকু, কন্ডাক্টরকাকু সবাই আমাকে চেনে। তারপর সবাইকে টা-টা করে নেমে গেল, যতক্ষণ না বাস ছাড়ল আমাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে লাগল।