- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

চেন্নাইয়ে কাজ করে পরবে দেশে ফিরছেন গোরাচাঁদ মিস্ত্রী

অমিতাভ সেন, কলকাতা, ১৩ নভেম্বর, গোরাচাঁদের স্কেচ লেখকের#

গোরাচাঁদ মিস্ত্রি দেশে ফিরছেন। ২৬ অক্টোবর সকাল ৭টা ১৫-র নামখানা লোকাল শিয়ালদা থেকে ছাড়ার পর একটা স্টেশন পার হতেই কামরায় ধুন্ধুমার কাণ্ড। ঈদের পরব আর দুর্গাপুজোর অবশিষ্ট ছুটির সাথে সপ্তাহান্তের শনি-রবি ও সোমবার লক্ষ্মীপুজোর ত্র্যহস্পর্শে ভিড়ের ঠেলায় সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত। জানলার ধারে এক অবাঙালি ভদ্রলোক জিনসের শার্ট প্যান্ট পরা। তার পাশে গোরাচাঁদ মিস্ত্রি আর তাঁর ভাগ্নের মাঝখানে আমার একটু বসার জায়গা হয়েছে।
আমার সামনের সিটে আমার বন্ধু সমরের টিকিও তখন দেখা যাচ্ছে না। সামনে মানুষের দুর্ভেদ্য দেওয়াল। জানলার ধারে তিনটে পাঁচ সাত বছরের বাচ্চাকে ঢুকিয়ে দিয়ে তাদের মা বাবারা যে কোথায় দাঁড়িয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। বাচ্চাগুলো দুই সিটের ফাঁকে দাঁড়িয়েই হল্লাগুল্লা করছে। শিশুর কান্না, মহিলা কণ্ঠের আর্তনাদ, হাতের মালপত্র উপচে পড়া বাঙ্কে তোলার জায়গা নেই বলে অন্যলোকের গায়ে মালের বোঝার চাপ কেন লাগবে — এই নিয়ে তুমুল চেঁচামেচি। আর এর মধ্যেই গোরাচাঁদ মিস্ত্রীর মাথাটা ঢুলে ওপাশের অবাঙালি ভদ্রলোকের ঘাড়ে পড়ল! সেই ভদ্রলোক তখন তাঁর হাঁটুর কাছে দাঁড়ানো বাচ্চা তিনটেকে নিয়ে অস্থির — একজন তাঁর কোলে চেপে বসেছে, আরেকজন চলন্ত ট্রেনের জানলা দিয়ে থুথু ফেলায় সে থুথু তাঁর গায়ে এসে পড়েছে। তিনি তাকে একটু আগেই ছোট্ট একটা চাঁটি দিয়ে থুথু ফেলার জন্য  তিরস্কার করে তাঁর হাতে লাগা থুথু ওই বাচ্চাটার জামাতেই মুছে নিয়েছেন।
এমন সময় গোরাচাঁদ মিস্ত্রির ঘুমে ঢলা মাথা তাঁর ঘাড়ে ধাক্কা মারায় তিনি খুবই বিরক্ত, ণ্ণআহ্‌, সোজা হয়ে বসুন। দেখছেন এই বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কী মুশকিলেই পড়েছি, তারপর আবার’। গোরাচাঁদ মিস্ত্রি সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় তুলে আহা আহা বলে লজ্জা প্রকাশ করে আমার দিকে ফিরে বললেন, ণ্ণচোখটা এঁটে এয়েচে। রাতে ঘুম হয়নি তো।’ আমি বললাম, কোথা থেকে আসছেন? গোরাচাঁদ বলতে থাকেন, পরশু দিন বিকেল সাড়ে পাঁচটায় প্ল্যাবন্ট থেকে রওনা দিয়েছি। চেন্নাই থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে। এসে দেখি জেনারেল কমপার্টমেন্টে পা দেওয়ার জায়গা নেই। রিজার্ভেশন ছিল না। ওতেই চেপে বসলাম। শোওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। ঠায় দাঁড়িয়ে এসেছি খড়্গপুর পর্যন্ত, তারপর চেয়েচিন্তে বাঙ্কের ওপর একটু বসার জায়গা পেয়েছিলাম। ভোরবেলা সাড়ে চারটা-পাঁচটায় ট্রেন ঢুকেছে। তবে সবচেয়ে কষ্ট কী জানেন দাদা? ২৪ ঘণ্টা পেচ্ছাপ করতে পারিনি। মানুষের ঘাড়ে পা দিয়েও বাথরুমে যাওয়া যাচ্ছে না। জল খেতে পারছি না পেচ্ছাপ পাবে বলে। সঙ্গে ভাত ছিল, খাব কী করে, হাত নোংরা, হাত ধোওয়ার জায়গা নেই। এমনকী থালাটা যে হাতে ধরে খাব তারও উপায় নেই।
এই অবধি শুনেই আমার মনে হল নামখানা লোকাল তো স্বর্গ — যদিও সামনে দাঁড়ানো ছেলেটা এরই মধ্যে বমি করেছে জানলায়। অবাঙালি ভদ্রলোক তাকে দিয়ে জানলা পরিষ্কার করিয়েছেন একটুও বিরক্ত না হয়ে। উল্টোদিকে একজন ভিড়ের চাপে হাঁসফাঁস করে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। বন্ধু সমরের জলের বোতল প্রায় শেষ তার জ্ঞান ফেরাতে। এত কষ্ট, কিন্তু সকলের প্রতি সকলের একটা সহমর্মিতা দেখা যাচ্ছিল। যার ছিঁটেফোঁটা দেখা যায়নি গোরাচাঁদ মিস্ত্রির চেন্নাই থেকে আগত ট্রেনের যাত্রার বর্ণনায়। কে জানে ওখানে বোধহয় অবস্থাটা আরও অনেক বেশি খারাপ ছিল।
কাজের জন্য গোরাচাঁদ তাঁর ভাগ্নে ও প্রতিবেশী এক মুসলমান যুবককে নিয়ে গিয়েছিলেন চেন্নাই থেকে ষাট কিলোমিটার দূরে ণ্ণমোহন বিয়ারস কোম্পানি’তে। পাইপ ইনস্টলেশনের কাজ। সঙ্গে বড়ো ছেলেও ছিল। তাকে ষষ্ঠীর দিন পাঠিয়ে দিয়ে আজ তিনি বাকি দুজনকে নিয়ে ফিরছেন। কাজের চাপ ছিল। কোম্পানি ছুটি দিতে চাইছিল না। অনেক কষ্টে ছুটি পেয়েছেন। এখন বাড়ি ফিরছেন। লক্ষ্মীকান্তপুর নেমে ধোলের মোড়, জুমাই নস্কর হাটে তাঁর বাড়ি যেতে আরও আধঘণ্টা। চল্লিশ মিনিট বাসে চাপতে হবে। বাড়িতে তাঁর বউ-দুই ছেলে-দুই মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। তাদের শ্বশুর বাড়িও বেশি দূরে নয়। ছোটো মেয়ের বিয়ে হয়েছে বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থের ঘরে। ওনার নিজের দু-বিঘে জমিতে খোরোর চাষে ৩৬/৪০ মণ ধান হয় — তাতে বছরের খোরাক হয়ে যায়। বাকি সময় তিনি নানারকম কাজ করতে দূরে দূরে যান।
কলকাতায় থাকি, শুনে বললেন, আপনাদের ওখানে অনেক কাজ করেছি। শেষ কাজ করেছি সাউথ সিটি মলে। তবে চেন্নাইতে রোজ দ্বিগুণেরও বেশি। আমি তো পুজোর কিছু আগে আসামে কাজ করতে গেছলাম। ওখানে দাঙ্গা লেগে যাওয়ার ঠিক দশদিন আগে চলে এসেছিলাম। সেটাই বাঁচোয়া, সঙ্গে মুসলমান ছেলে ছিল। কী সুন্দর জায়গা, শিলচর, গৌহাটি, কামরূপ — শুধু কামাখ্যা মন্দিরটাই দেখা হল না। আমি তো যেখানেই কাজে যাই, সেই জায়গাটা ঘুরে আসি। সঙ্গের যুবককে দেখিয়ে বললেন, একবার ওর চাচাকে নিয়ে ওড়িশার বেরহামপুর গেছলাম — এক কেমিকাল কোম্পানিতে কাজ করতে — পিচ, ন্যাপথালিন আর কী সব বানায়। কাজ করতে গিয়ে দেখি কেমিকালের অ্যাকশনে হাত-মুখের চামড়া খসে যাচ্ছে। ওখানকার লোকাল মেয়েগুলো দেখলাম মুখে গিরিমাটি লাগিয়ে কাজ করছে। আমরা অবশ্য বেশিদিন করিনি। ভয় করছিল। ওদিকে বাবুরা তো কাজে নিয়ে যাওয়ার সময় রাজার ব্যাটার মতো খাতির করে নিয়ে যায় — রিজার্ভ করা টিকিট, টাইমে টাইমে খাওয়া, ফেরার সময় আর চিনতেই পারে না। আমি ওর চাচাকে বললাম, চল কাছে গোপালপুরে সমুদ্র আছে — ফেরার পথে দেখে যাই।
এর মধ্যে জয়নগরে গাড়ি ফাঁকা হয়েছে বেশ। আমি জানলায়। গোরাচাঁদকে জিজ্ঞেস করে চিনে নিলাম কোনটা পানিফলের খেত আর কোনটা শোলার। সে বললেন, শোলাচাষে আজকাল খুব লাভ। তবে অনেক জল লাগে। আর শোলার গোড়া পচে জমিতে ভালো সার হয় ধানের জন্য। কিন্তু শোলার চাষের জমিতে ধান চাষ করা মুশকিল ওই জল জমে থাকায়।
আরেকটা ব্যাপারও জানা গেল। গোরাচাঁদ বললেন, অন্ধ্রপ্রদেশের ওপর দিয়ে আসার সময় দেখলাম ধান হয়েছে খুব, কিন্তু পাকা ধানে ওরা পোকা মারা বিষ দিচ্ছে। ওতে দুধ খাওয়ার পোকা মরে — ধানের ফলনও বেশি হয়। কিন্তু ওই চাল শরীরের পক্ষে খারাপ। আমরা কখনো তা করি না।
চলে যাওয়ার সময়ে গোরাচাঁদ মিস্ত্রি নমস্কার জানিয়ে মোবাইল ফোনের নাম্বার দিয়ে গেলেন। ওঁদের বাড়ি যাওয়ার নিমন্ত্রণও করে গেলেন। বন্ধু সমর পরে বলল, দেখেছিস, ওনাকে দেখতে অনেকটা ঠিক রামকিঙ্কর বেজের মতো।