জিতেন নন্দী, বজবজ, ৩১ আগস্ট#
প্রায় দু-বছর ধরে ভাবছি ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলব। কিন্তু ওঁর ফুরসত কোথায়! শিয়ালদা স্টেশনে বজবজ লোকাল ঢোকে। আমরা হুড়মুড় করে কামরায় উঠে বসার জায়গা ম্যানেজ করি। যারা নিত্যযাত্রী এবং তাস খেলার প্লেয়ার, তারা পার্টনারদের জন্য জায়গা বুক করে নেয়। ইতিমধ্যে ঢুকে পড়ে চা … এ-ই-চা …, কাঁচি হাতে চানাচুর-কটকটি-ডালমুট-ঝুড়িভাজা, শণপাপড়ি কিংবা চিপস। আমি আর কিছু খাই না খাই, চা খাবই। লেবু চা — আগে ছিল এক টাকা, এখন একটু বড়ো সাইজের প্লাস্টিকের গ্লাসে দু-টাকা, সঙ্গে এক টাকাও চলছে। দু-চারবার কথা বলতে গেছি বটে। কিন্তু চা বিক্রেতার সময় একেবারে মাপা। কারণ লোকাল ট্রেন ছাড়ার সামান্য আগেই স্টেশনে আসে। মাঝের সময়টুকুতেই তাঁকে সবকটা বগি কভার করতে হয়।
শিয়ালদা স্টেশনের ভিতর চায়ের হকারির অনেকগুলো শ্রেণীভাগ এবং উপভাগ আছে। একদল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নির্দিষ্ট জায়গায় চা বিক্রি করে; একদল ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার পর বগিতে উঠে বিক্রি করে; একদল ট্রেন ছাড়ার পর বগিতে বগিতে বিক্রি করে এবং একটা নির্দিষ্ট সীমা-স্টেশন পর্যন্ত চলে যায় ও ফিরে আসে। লোকাল এবং দূরপাল্লার ভাগ রয়েছে। এছাড়া রয়েছে নর্থ সাউথ ভাগ, নর্থ সাউথের মধ্যে আবার বিভিন্ন লাইন যেমন বনগা বারাসাত ডানকুনি ক্যানিং লক্ষ্মীকান্তপুর বজবজ ইত্যাদি ভাগ। তার ওপরে আছে লেবু চা এবং দুধ চায়ের ভাগ।
আমার পরিচিত চাওয়ালা লোকাল ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার পর বগিতে উঠে বিক্রি করেন। তবে সব লোকালে নয়, নির্দিষ্ট কিছু লোকালে এবং নির্দিষ্ট সময়ে।
গতকাল আমি আটটা পয়ঁত্রিশের লোকাল ধরব বলে এগোচ্ছি। দেখি একটা বড়ো পেটির ওপর তিনি বসে রয়েছেন। পরনে সেই নীল রঙের ইউনিফর্ম গোছের জামাপ্যান্ট। কী ব্যাপার? আমি কখনো ওঁকে বসে থাকতে দেখিনি। সবসময়ই একটা নির্দিষ্ট ছন্দে ছুটে চলতে দেখেছি। আজ কী হল?
ধনঞ্জয় মাইতির কথা
আমার বাড়ি হাওড়া জেলার শ্যামপুর থানার কমলপুরে। কাজের জন্য বারুইপুর লাইনে মল্লিকপুরে থাকি। হপ্তা হপ্তা বাড়ি যাই। ছেলেমেয়ে-বউ দেশে থাকে। মা-বাবা দুজনেই মারা গেছে। ত্রিশ বছর আগে শিয়ালদায় এসেছিলাম। আমি তখন এতটুকু বাচ্চা, স্টেশনের ওপারে একজন মহামেডানের মিষ্টির দোকানে কাজ করতাম। তারপর আস্তে আস্তে এখানে লাইন ধরলাম। বিয়ে-থা করলাম। চায়ের হকার দু-রকমের — রানিং আর স্টেশনের। আমরা প্রায় ২৩০-২৫০ জন স্টেশনে ট্রেনে উঠে চা বিক্রি করি। ডেলি পাঁচ-ছশো কাপ চা বিক্রি হয়। এক টাকা আর দু-টাকা মিলে। দু-টাকার হিসেবে ধরলে গড়ে তিনশো কাপ। চা নিজেই বানাই। কোলে মার্কেট থেকে লেবু কিনছি এখন তিনশো টাকা শ’। ভালো লেবু। আর চা পাতা চিনি তো আছেই।
প্রত্যেকদিন শিয়ালদায় এসে ভোর চারটে পয়ঁতাল্লিশের বজবজ লোকাল থেকে স্টার্ট করি। সকাল আটটা অবধি করে বাড়ি চলে যাই। ফের দুপুর তিনটে থেকে রাত ন-টা পর্যন্ত। আজ আমার চা শেষ হয়ে গেছে সাতটা নাগাদ। কম করে বানিয়েছিলাম। গরমের দিন। আজ আর বানাব না।
আমাদের লাইনে ফান্ড আছে। ফান্ড থেকে পুজোর সময় বোনাস দেওয়া হয়। আমাকে ডেলি পাঁচ টাকা করে দিতে হয়। প্রত্যেকের আলাদা কার্ড আছে। কার্ডে নাম, ঠিকানা, ছবি, ফোন নাম্বার সব আছে। ফান্ড আগে ছিল সিপিএমের, এখন তৃণমূলের। আবার যে আসবে, তার হবে। ওটা কিছু না।