- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

চারপাশের অমানবিকতার সঙ্গে লড়াই করেও বাঁচাতে পারিনি তাঁকে

৯ মে, কাজী ফয়জল নাসের, কানখুলি, মহেশতলা#

সোমবার ২৯ এপ্রিল কলকাতা শহরে সরকারি আইনকানুনের জালে অমানবিকতার এক অদ্ভূত রূপ দেখতে পেলাম। অফিস ফেরত মাঝেরহাট স্টেশনের প্লাটফর্মে এক ষাটোর্ধ বৃদ্ধকে মুমূর্ষ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে আমি ও আমার সহযাত্রী দুই বন্ধু, স্টেট ব্যাঙ্কের  সোমনাথ পাল আর ব্যাঙ্ক অব বরোদার সায়ক নন্দী, স্রেফ মানবিকতার খাতিরে কলকাতা  পুলিসের হেল্পলাইন ১০৭৩-এ ফোন করি। সেখান  থেকে বলা হয় যেহেতু বিষয়টি রেলওয়ের এলাকাভুক্ত তাই স্টেশন মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করে RPF-এর সাহায্য নিয়ে তাঁর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। আমরা স্টেশন মাস্টারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি নির্বিকার চিত্তে বলে দিলেন যে তাঁদের কিছু করার নেই, অ্যাকসিডেন্ট হলে বা মারা গেলে তারা ‘বডি’ তুলতে পারেন, নচেৎ নয়।

এরপর শুরু আমাদের অবিরাম চেষ্টা মৃতপ্রায় লোকটার জন্যে কিছু করার। অথচ স্টেশন ভর্তি মানুষের কারো কোনো হেলদোল নেই। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত যতভাবে সম্ভব চেষ্টা করার পর নিউজ টাইম (News Time Channel)-এর দুজন correspondent ঘটনাস্থলে আসেন। তাঁদের ক্যামেরার সামনে পড়ে অবশেষে স্টেশন মাস্টার বালিগঞ্জ GRP-তে খবর দেন। RPF পৌঁছায় প্রায় আটটার সময়। তারপর আমরা তাঁকে বিদ্যাসাগর হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে সমস্ত formalities মিটিয়ে ভর্তি করলাম রাত সাড়ে নটায়। ইতিমধ্যে ঘটনাচক্রে পেয়ে গেছি আমার ফেসবুক বন্ধু তথা রাইটার্স-এই আমার সহকর্মী ইন্দ্রনীলকে। সেও আমাদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিল। আর নিউজ টাইম-এর শৌভিক সরকার, শেষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে সমস্ত বিষয় তদারকি করে তবে বিদায় নেন। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তারবাবু যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেন। কিন্তু কর্তব্যরত সিস্টার দু-জন এতই খারাপ ব্যবহার করেন আমাদের সাথে যে শেষ পর্যন্ত আমাদেরও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে ও অল্প তর্কাতর্কিও হয়।

হাসপাতালের ডাক্তারবাবুর কাছে ওই ব্যক্তি কোনোরকমে জানান যে তাঁর নাম শৈলেন সরকার এবং বাড়ি বাঁকুড়ার রাঙামাটি অঞ্চলে। পরের দিন হাসপাতাল থেকে বেহালা থানায় খবর পাঠানো হয় এবং বেহালা থানা থেকে বাঁকুড়ার আঞ্চলিক থানায় যোগাযোগ করে শৈলেনবাবুর বাড়ির লোকজনকে খবর দেওয়া হয়।

কিন্তু এতকিছুর পরেও আমাদের দুর্ভাগ্য যে তিনদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করার পর ২ মে, বৃহস্পতিবার বিকেলে অবশেষে তিনি হার মানেন। শুক্রবার তাঁর বাড়ির লোকের হাতে শৈলেনবাবুর মরদেহ তুলে দেওয়া হয়।

এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে সমাজে মানবিকতা আজ লুপ্তপ্রায় হতে চলেছে। তারই মাঝে আমাদের সাথে যারা যারা এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের সকলকে আমার অসংখ্য ধন্যবাদ। আর ধিক্কার জানাই মাঝেরহাট স্টেশনের স্টেশনমাস্টার, বিদ্যাসাগর হাসপাতালের নার্স সহ তাদেরকে, যাদের অসহযোগিতা আর দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতার জন্য সেই বৃদ্ধের চিকিৎসায় অন্তত দু-ঘন্টা দেরি হয়। আশা করব ভবিষ্যতে আর কোনো মানুষের যেন শৈলেনবাবুর মতো অসহায় অবস্থায় পড়তে না হয়। তাই আমাদের বোধহয় আরও একটু মানবিক হওয়ার জন্য শপথ গ্রহণের সময় হয়েছে।