- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

চাপা আতঙ্কের পরিবেশ এখনও বহাল মাকড়ায়

মুহাম্মদ হেলালউদ্দিন ও শমীক সরকার, মাকড়া, ৩০ নভেম্বর#

এই ঢালাই রাস্তার কাজে দুর্নীতির অভিযোগ, যা গড়িয়ে যায় রাজনৈতিক সংঘর্ষে।
এই ঢালাই রাস্তার কাজে দুর্নীতির অভিযোগ, যা গড়িয়ে যায় রাজনৈতিক সংঘর্ষে। ছবি শমীক সরকারের তোলা। ৩০ নভেম্বর ২০১৪

রাজ্য রাজনীতি সরগরম বীরভূমের মাকড়া গ্রামের ঘটনায়। গ্রাম দখলের এই রাজনৈতিক সংঘর্ষে তিনজন প্রাণ হারিয়েছে। আহত অনেকেই। কুরবানির পরদিন থেকে যে সংঘর্ষ শুরু হয়, তাতে ঘরছাড়া হয় তৃণমূল কর্মীদের পরিবারগুলো। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে তারা প্রশাসনের সহযোগিতায় ণ্ণযুদ্ধ করে’, ‘মাথা উঁচু’ করে ফেরত আসতে চেয়েছিল। পারেনি। সেদিনের সংঘর্ষে মারা গেছে তিনজন, তাদের একজন বাইরের। ভাড়াটে গুণ্ডা হিসেবে এসেছিল। বাকি দু-জন এই গ্রামেরই — একজনের নাম তৌসিফ, আরেকজনের নাম মোজাম্মেল। প্রথম জন বিজেপি পরিবারের কিশোর। দ্বিতীয় জন তৃণমূল পরিবারের তরুণ।
আমরা তিনবন্ধু শমীক, বসির ও হেলাল ৩০ নভেম্বর মাকড়ায় পৌঁছাই। কথা বলি তৌসিফ ও মোজাম্মেলের পরিবারের লোকেদের সঙ্গে। বাইরে থেকে মনে হবে গ্রাম চলছে স্বাভাবিকভাবেই। গ্রামের ভেতরে রয়েছে চোরাস্রোত। উদ্বেগ-উত্তেজনা-আতঙ্ক। ধিকি ধিকি জ্বলছে আগুন, যে কোনো সময় লণ্ডভণ্ড ঘটিয়ে দিতে পারে। তৃণমূলের অনেকেই এখনও গ্রামে ফিরে আসতে পারেনি। তৃণমূলের নিহত মোজাম্মেলের দাদা শেখ এনামুল এবং কাকাতো ভাই আহত হওয়ার পর এখনও বাড়িতে, পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে কাতরাচ্ছেন বিছানায়। নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন। মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না। মোজাম্মেলের দিদি নারুলা বিবি কিছুতেই মিডিয়ার সামনে মুখ খুলতে ভরসা পাচ্ছেন না।

পুকুর খনন নিয়েও গ্রামের তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল, ছবিতে মাকড়ার পুকুরটি যন্ত্রে সংস্কার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ছবি শমীক সরকারের তোলা। ৩০ নভেম্বর ২০১৪
পুকুর খনন নিয়েও গ্রামের তৃণমূল নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল, ছবিতে মাকড়ার পুকুরটি যন্ত্রে সংস্কার হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ছবি শমীক সরকারের তোলা। ৩০ নভেম্বর ২০১৪

মোজাম্মেলের পরিবার আগে কংগ্রেসের ছিল। তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে তৃণমূল। পঞ্চায়েতের দখল ছিল তৃণমূলেরই। তাঁরা এখনও তৃণমূলেই আছেন। এই পরিবারের এক সদস্য মোজাম্মেলের ভাগনে শেখ জাহির বললেন, এই গ্রামে কাজের বন্যা বইয়ে দিয়েছে তৃণমূল। বারো কিমি কংক্রিটের রাস্তার স্যাংশন আদায় করেছে এলাকার মন্ত্রীর কাছ থেকে। এলাকার কোথাও এই ধরনের রাস্তা নেই। হাঁসড়া থেকে মাকড়া, আদিবাসী এলাকা কানপুর হয়ে আবার হাঁসড়া — অনেক লম্বা সেই রাস্তা। সেই রাস্তাও এখন সম্পূর্ণ। আগে মাকড়া থেকে বর্ষার সময় বের হওয়া যেত না, রাস্তা এত খারাপ ছিল। একটা গাড়ি যাতায়াত হত না। একটা পেশেন্টকে নিয়ে যেতে গেলেও খাটে চাপিয়ে নিয়ে যেতে হত। তাই মন্ত্রী তাড়াতাড়ি রাস্তার কাজটা স্যাংশন করে দিয়েছিল। ওই রাস্তা শুধু নয়, এলাকার তেরোটি পুকুর সংস্কার করা হয়েছে। একশো দিনের কাজের নিরিখে এই গ্রাম ইলামবাজার ব্লকে সেরা। কারোর বার্ধক্য ভাতা পাওয়াতে কোনো সমস্যা নেই। সবার রেশন কার্ড, বিপিএল কার্ড। মাকড়াতে কাজ সম্বন্ধে ফাঁকির কোনো ব্যাপার নাই। কিন্তু এই ঘটনাটা আলাদা। এখন ঝড় উঠেছে বিজেপির।

প্রসঙ্গত, পাড়ুই থেকে মাকড়া যাওয়ার পথে হাঁসড়া অবধি রাস্তা পিচের, দূরত্ব এগারো কিমি। এই পিচের রাস্তা এতটাই ভাঙা যে ডিজেল চলা ভ্যান বা ‘ভ্যানো’ করে যেতেই গায়ে ব্যথা হয়ে যায়। হাঁসড়া দিয়ে চলে যায় সিউড়ি-ইলামবাজারের বাস। কিন্তু হাঁসড়ার কাছে ব্রিজ ভেঙে যাওয়ায় এই বাসের যোগাযোগও ঠিকঠাক নেই এখন। হাঁসড়া থেকে আরেকটা রাস্তা চলে গেছে মাকড়া গ্রামের দিকে, সদ্য তৈরি কংক্রিটের রাস্তা। পাড়ুই থেকে হাঁসড়া যাওয়ার পথে প্রথমেই পড়ে চৌমণ্ডলপুর গ্রাম, তার বাঁদিকে ছ্যাতরাবান্দা, ডানদিকে বেলপাতা — তারপর হাঁসড়া।
গ্রামের বিজেপি নেতা শাহজাহানের (যিনি প্রথমে সামনে আসেননি, গ্রামে পুরুষরা সহজে সামনে আসছে না) সাফ কথা — রাস্তা তৈরি, পুকুর সংস্কারের নামে টাকার মোচ্ছপ চলছে। পঞ্চায়েতের একশো দিনের কাজ না পাওয়া ও কাজ করে পয়সা না পাওয়া — এসবই চলছে। তেরোটি পুকুরের সংস্কারের কাজ হয়েছে, রাস্তার কাজ হয়েছে — অথচ মজুরি পায়নি গ্রামবাসীরা। এই অন্যায় মেনে নিতে পারেনি গ্রামের লোক। তাই দল বেঁধে সব তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগ দিয়েছে। এখানে পঞ্চায়েতের চোদ্দটি আসনেই জিতেছিল তৃণমূল।
শাহজাহানের কথায়, সে অনেক আগে কংগ্রেস করত, তারপর সিপিএমে চলে আসে। তারপর তার ভোটটা তৃণমূল মেরে দিত। এখন সে বিজেপি করছে। সে বলল, সিপিএমের এলসিএস লাড্ডু মানে লাল মহম্মদের জমির ধান কেটে নিয়েছিল তৃণমূল। আমরা কি তা করছি? ১২-১৪ জন, যারা গণ্ডারের মতো ব্যবহার করেছে, তারা ছাড়া তৃণমূলের আর সবাইকে গ্রামে ঢুকতে দিয়েছি। তাদের পরিবার পরিজন তাদের ঘরেই আছে। তাদের জমির ধান তাদের গোলায় তুলে দিয়েছি। সিপিএম এর লোকেরা এখনও বামফ্রন্টেই আছে। কিন্তু তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করার জন্য বিজেপি করছে এখন। পাশ থেকে একজন বললেন, গ্রামে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল না।
মোজাম্মেলের পরিবার থেকে অবশ্য জানা গেল, গ্রামের তিরিশ জনের মতো পুরুষ, তৃণমূলের কর্মী, তারা বাইরে আছে এখনও। মহিলারাও বাইরে ছিল। এখন ধান কাটার জন্য ঢুকেছে। মোজাম্মেলকে মেরে ফেলেছে, তার দুই ভাইকে মসজিদ থেকে বের করে বেধড়ক মেরেছে। কারা মেরেছে, এই প্রশ্নের উত্তর তারা দিল না। তবে গ্রামের লোকেরাই মেরেছে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাতে তারা না বলল না।
আমরা কথা বলার ফাঁকেই শাহজাহানের ফোনে খবর আসে, তৃণমূল নেতা মুস্তাক (যে তৌসিফ খুনে অভিযুক্ত, জানিয়েছিল শাহজাহান) প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করবে। শুনেই সে উত্তেজিতভাবে গ্রামে গ্রামে মহিলাদের দিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংগঠিত করার কথা ফোনেই কাউকে বলতে লাগল। আমরাও বুঝে গেলাম, সংঘর্ষে ইন্ধন রয়েছে দু-পক্ষেরই।