- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

গোপালঠাকুরের দুধপানের গুজবের নেপথ্যে

অলকেশ মন্ডল, বাগনান, হাওড়া, ১৪ সেপ্টেম্বর#

ছবি প্রতিবেদকের তোলা।
ছবি প্রতিবেদকের তোলা।

আবার দুধ পানের গুজব। এবার গোপালঠাকুর। মনের সুখে নাড়ুগোপালকে দুধ পান করিয়ে মানুষ আত্মতৃপ্তি লাভ করে চলেছে। প্রথমবার ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সারা ভারতজুড়ে গণেশের মুর্তি দুধ পান করেছিল। আবার ২০০৬ সালে অল্প মাত্রায় একই গুজব ছড়িয়েছিল। সেই সব ঘটনা বয়স্কদের কাছে পুরোনো, এমনকি অনেকের স্মৃতি থেকে মুছেও গেছে। আর আজকের উঠতি প্রজন্মের কাছে এটা ঐতিহাসিক ব্যাপার। দুধ পানের রহস্যের কারণগুলোও যে সেই সময় সবাই জেনেছিলেন বা বুঝেছিলেন এমনটাও নয়। তাই আবার যখন প্রসঙ্গ উঠেছে সবাই চেষ্টা করেছে নিজের বাড়ির গোপালঠাকুরটিকে দুধ পান করানোর জন্য। আগের মতোই কেউ দুধ পান করিয়ে আনন্দে নেচেছে আবার দুধ গড়িয়ে পড়ছে দেখে অনেকে হতাশ হয়েছে।
এই বছরে ৫ সেপ্টেম্বর ছিল জন্মাষ্টমী মানে গোপালের জন্মদিন। তার এক সপ্তাহ আগে থেকেই দুধ পানের গুজব শুরু হয়ে যায়। ইদানিং যে কোনও ঘটনার খবর মোবাইলের সুবাদে তাড়াতাড়ি অন্যের কানে পৌঁছে যায়। এই গুজবের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। এক পাড়া থেকে অন্য পাড়া হয়ে জেলা থেকে জেলায় পৌঁছে গেছে। হাওড়ায় নিজের গ্রামের কলেজপড়ুয়ার থেকে গত ১ সেপ্টেম্বর প্রথম শুনেছিলাম। আর আজ ৮ তারিখে পূর্বমেদিনীপুর থেকে এক স্কুলশিক্ষক ফোনে জানালেন যে তাঁর এলাকায় এই দুধ পানের হিড়িক চলছে। তিনি দুধপানে বিশ্বাস করেন না, তবে এই রহস্যের প্রকৃত কারণটা জানতে চাইলেন। আরো অনেক জায়গা থেকে ফোন আসছে। কেউ জানাচ্ছেন। কেউ জেনে নিচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গে গোপালের দুধ পানের ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০০৮ সালের মার্চ-এপ্রিল মাসে নদীয়া ও উত্তর ২৪ পরগণা জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই গুজব ছড়িয়েছিল। তখন আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির সদস্যরা সেই সব এলাকার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে প্রকৃত রহস্য জানিয়ে দেবার দায়িত্ব নিয়েছিল।
গণেশমুর্তি কিংবা গোপালমুর্তি -দুধ পানের বৈশিষ্ট্য সর্বত্র প্রায় একই। তাই প্রশ্ন ওঠে- ১) বোতলে বা গ্লাসে নয়, এমন কি দেবতাদের নির্দ্ধারিত পাত্র কোষা-কুষি নয়, ম্লেচ্ছদের চামচের সাহায্যে পান করানো হয়েছে কেন?
২)গণেশের প্রিয় লাড্ডু, বা গোপালের প্রিয় ননী বা মাখন না খাইয়ে কিংবা অন্য কোনও পানীয় নয়, কেবল দুধ পান কেন?
যাঁরা দেবতাকে রোজ ফল-মুল-ভোগ দেন তাঁরা মনে করেন যে এটা দেবতা গ্রহন করেন। কখনও মনে করা হয় যে দেবতা পিঁপড়ে বা অন্য প্রাণীর রূপ ধরে খেয়ে যান। আসলে বিশ্বাসী মানুষজন আত্মতুষ্টির সুযোগ খোঁজেন। আবার গুজব শুনেও মানুষ কিন্তু পরখ করে দেখেন। সাদা তরল চামচের সাহায্যে মুর্তির মুখের কাছে ঠেকাতেই যদি ভ্যানিশ হয়ে যায় তবে তো মানুষ চমকে যাবেই। আর আনন্দের আতিশয্যে তখন পাড়া মাত করে। আমার হাতে ভগবান দুধ পান করেছে- একি চাট্টিখানি কথা? এই অবোধ আতিশয্য গুজব তৈরী করে।
অন্যদিকে যাঁরা দুধ পান করাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বোধবুদ্ধি বরং বেশী। কিন্তু তাঁদের সে কথা লুকানোই থাকে। আমি পাপী তাই আমার হাতে দেবতা খায়নি -হয়ত এরকম অপরাধ বোধও কাজ করে। আসল ঘটনা এইবার বুঝে নেওয়া যাকঃ-
চামচে বা যে কোনও পাত্রে দুধ ঢাললে ভর্তি হয়েও কিছুটা দুধ ওপরে উঠে থাকে। তরলের এই ধর্মের নাম পৃষ্ঠটান (SURFACE TENSION)। এখন চামচ ভর্তি দুধ মুর্তির গায়ে ঠেকালে প্রথম ফোঁটা দুধ মুর্তির গা বেয়ে নীচে নামে এবং বাকী তরলটা নেমে যাবার রাস্তা তৈরি হয়ে যায়। তারপর আবার চামচভরা দুধ দিলে তরলের অন্য ধর্ম কৌশিক ক্রিয়া (CAPILARY ACTION)-র জন্য ভিজে থাকা অংশ বরাবর দুধ নীচে নেমে যায়। যেভাবে কাঁচের জানালায় বৃষ্টির ফোঁটা গড়িয়ে নামে। সাদা পাথরের বা সাদা রং করা মুর্তির গা বেয়ে সাদা দুধ নেমে গেলে তা একপ্রকার অদৃশ্যই থাকে। অন্ধবিশ্বাসী যাঁরা তাদের নজর থাকে চামচের দুধের ওপর। দুধের গড়িয়ে যাওয়া, নীচে জমা হওয়া কিংবা মুর্তির পরিধান ভিজে যাওয়া তাঁর নজরে আসে না। কিংবা বলা হয়- আমার গোপাল আড়াই চামচ দুধ পান করেছে। আসলে আড়াই চামচ দুধ গড়িয়ে যাবার পর মানুষটির সম্বিত ফিরেছে। এই অনাবশ্যক জাহির করাটা লজ্জার বিষয় হলেও তাঁরা এটা গৌরবের মনে করেন।
তাই অন্ধবিশ্বাস যতদিন সমাজে থাকবে গনেশ বা গোপাল দুধ পান করেই যাবে।