- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

গঙ্গার জলসমীক্ষায় সাতদিন

২৩ মার্চ, রাজীব দত্ত#

কানপুরে গঙ্গা।
কানপুরে গঙ্গা।

গঙ্গার মোট গতিপথের মধ্যে ৮০০ কিলোমিটার মতো এলাকায় আমাদের কাজ। গঙ্গার তিনটে প্রবাহ আছে। তার মধ্যে উচ্চগতি হল গঙ্গোত্রী থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত। সাধারণভাবে নদীর প্রবাহকে তিনটে অংশে ভাগ করা যায়। উচ্চগতি হল নদীর সেই অংশ যেখানে তার স্রোত সবচেয়ে বেশি এবং বিস্তার সবচেয়ে কম, যেখান থেকে নদীর উৎপত্তি, জিরো পয়েন্ট, বরফ গলে জল হয়ে বেরোচ্ছে। সেখান থেকে যতদূর পর্যন্ত নদী এমন এক গতি নিয়ে বইছে, যেখানে পলি জমতে পারে না, সেই অংশ উচ্চগতির। এর পরের অংশ হল মধ্যগতি। সেখানে স্রোত কিছুটা কমে আর নদী অনেকটা চওড়া হয়, নদীর দুপাশে চর আর পলি তৈরি হয়। এটা সাধারণত সমতলে এসেই নদীকে পেতে হয়। উচ্চগতি মানে নদীর পার্বত্য অঞ্চল। তৃতীয় অংশ হল নিম্নগতির, যে পর্যায়ে নদী সমুদ্রে পড়বে। এই অংশে নদীর স্রোত একেবারে ধীর হয়ে যায় এবং তাতে জোয়ার-ভাটা খেলে, অর্থাৎ একটা উল্টো স্রোতও দেখা দেয়। এখানে বদ্বীপ তৈরি হয়, চর দেখা দেয় আর নদীর বিস্তার সবচেয়ে বেশি। এই মোটামুটি ভাগ। সব নদীতে যে এরকম স্পষ্ট ভাগ করা যায়, ট্যাঁ নয়। কিন্তু গঙ্গার মতো একটা নদীতে লম্বা এক গতিপথের মধ্যে এটা পাওয়া যায়। হরিদ্বারের পর থেকে গঙ্গার মধ্যগতি শুরু হয়। আমাদের কাজ ছিল পরবর্তী ৮০০ কিলোমিটারে সমীক্ষা। শেষপ্রান্ত হল বড়ো শহর এলাহাবাদ।
হরিদ্বার শহরের বাইরের মূল স্রোত থেকে কেটে আনা হয়েছে নদীকে। কাটিয়ে আনা অংশেই ব্রহ্মকুণ্ড, যেখানে পূণ্যার্থীরা স্নান ইত্যাদি করে। আমরা গঙ্গার মূল স্রোত, যেটা শহরের বাইরে দিয়ে গেছে, সেখানে পৌঁছানোর চেষ্টা করলাম। সেখানে গিয়ে নদীর চরে নেমে দেখলাম যে এখান থেকে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে। কাজ বলতে জলের নমুনা সংগ্রহ করা, মানচিত্র তৈরি করা, সেটা অবশ্য জিএসআই নিজেরাই করে। নদীর চর বরাবর এগোলাম। দুটো ব্যাপার দেখলাম। এক, নদী পাহাড় থেকে সমতলে নেমেই অসম্ভব বিস্তৃত হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও পাঁচ-ছয় কিলোমিটার ছড়িয়ে গেছে নদী। তার মাঝে মাঝে চর জেগে উঠেছে। কোনটা যে মূল স্রোত বোঝা কঠিন হয়ে গেছে। দ্বীপের মতো, তাতে জঙ্গল, মোষ স্নান করানো, মানুষের অস্থায়ী আস্তানা ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে কোনো কোনো জায়গায় গুজ্জররা মোষের ঘর তৈরি করে হরিদ্বার শহরে দুধ সরবরাহ করছে। মানুষ বুঝতে পেরেছে এখানে নদীর কাছ থেকে বিপদ কম, তাই সে বসতি গড়েছে। নদী যাতে আর না ভাঙে, তার জন্য নদীর ধারে ধারে বোল্ডার ফেলা হয়েছে। সরকারি উদ্যোগ যেমন আছে, আবার একটা গা-ছাড়া ভাবও লক্ষ্যণীয়। প্রচুর লোক, বেদে ইত্যাদিরা ওরই মধ্যে বোল্ডার সরিয়ে ঝুপড়ি তৈরি করে বসবাস করছে। দোকানপাটও রয়েছে। এক সমান্তরাল অর্থনীতি তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় যেটা দেখলাম, নদী থেকে যাতে কোনো দুর্ঘটনা না হয়, সেটা দেখা সরকারের কাজ। সেটা হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি। কারণ এই মানুষেরা এখানে থাকছে। মূল উদেশ্যটা ব্যর্থ হচ্ছে।
চণ্ডীপাহাড়ের কাছকাছি একটা ব্রিজ আছে। সেখান থেকে নদীর ভাটির দিকে চার কিলোমিটার মতো আমরা এগোলাম। নদীর চর ধরে যাচ্ছি। নদীর বুকে দীর্ঘদিনের জলের স্রোতে বোল্ডার-পাথরগুলো মসৃণ হয়ে গেছে। এক জায়গায় গিয়ে নদী বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সিগাল, গাঙচিল জাতীয় কিছু পাখি চোখে পড়ল।
পরদিন আমরা বিজনৌর থেকে কাজ শুরু করলাম। নদীর মানচিত্র খুললে আমরা বিজনৌরের আগে কোনো উল্লেখযোগ্য গ্রাম পাচ্ছি না। বড়ো কোনো গঞ্জও নেই। গঙ্গার আশপাশে যেসব বড়ো শহর গড়ে উঠেছে, তার তুলনায় বিজনৌর কোনো নামই নয়। হরিদ্বার থেকে বিজনৌর প্রায় ৯০ কিলোমিটার রাস্তা। নাজিবাবাদ একটা বড়ো রেল স্টেশন, একটা গঞ্জ-শহর। নাজিবাবাদ হয়ে বিজনৌর যেতে হয়। হরিদ্বার থেকে একটা গাড়ি ধরে ৫০-৫২ কিলোমিটার দূরে নাজিবাবাদে পৌঁছালাম। সেখান থেকে গাড়ি পাল্টিয়ে বিজনৌর এলাম। এসে লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, নদী কোথায়? ওরা বলল, গঞ্জে চলে যান। একটা অটো নিয়ে গঞ্জে গেলাম। আসলে জায়গাটার নাম দারানগর গঞ্জ। ওখানে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানেই বা নদী কোথায়? লোকে বলল, এখান থেকে বেশ কিছুটা গেলে একটা গ্রাম পড়বে, গ্রামের শেষমাথার পরে চর, চর পেরোলেই নদী। — কোন গ্রাম? কেউ নিজামতপুরা বলছে, কেউ বলছে জেহানাবাদ। রওনা দিলাম। তিন কিলোমিটার দূরে জেহানাবাদ গ্রাম। মুসলমান অধ্যুষিত গ্রাম। গ্রামের শেষমাথায় একটা মসজিদ। আমাদের বলা হল, ওর পরেই গেলে দেখবেন নদী শুরু হয়েছে। কিন্তু সেখানেই বা নদী কোথায়? দিগন্ত বিস্তৃত কাশ আর গমের খেত। আখও আছে। প্রথমে হাঁটতে শুরু করলাম। একটা ট্র্যাক্টর পাওয়া গেল, চালক খেতে জল দিতে যাবে। তার পিঠে চেপে বসা হল। ওর খেতটা সামনেই। সে আমাদের আরও কিছুটা এগিয়ে দেবে। এক কিলোমিটার এগিয়ে দিল। তারপর আবার হাঁটা। একটা কাশবন পার হয়ে যাচ্ছি। দেখি জঙ্গলের ভিতর থেকে কতকগুলো জন্তু তাকিয়ে আছে। প্রথমে ভেবেছিলাম মোষ। কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে ওরা উল্টোদিকে ছুট লাগাল। সরু সরু শিং, মনে হল এক ধরনের নীলগাই। জায়গাটা বসতির বাইরে। আরও প্রায় আড়াই-তিন কিলোমিটার পার করে এলাম। প্রথম একটা ফাঁকা জায়গা পেলাম যেখানে সাদা বালি আর কোনো খেত নেই। বুঝলাম এটা নদীরই বালি। সেখানে বেড়া দেওয়া আছে, ভিতরে কাঁকুড় আর তরমুজের চাষ হয়। মনে হয় বারোয়ারি জমি, কারো নিজের খেত নয়, যে যার মতো এসে দেখছে। ওখানে একজন লোক খোঁড়াখুঁড়ি করছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, নদী কোথায়? তিনি বললেন, সোজা এই চরের শেষ প্রান্তে চলে যান, নদী আছে। বেরিয়ে পড়েছি, অগত্যা এগোতেই হবে। আরও দেড়-দুই কিলোমিটার যাওয়ার পরে একটা নদীঘাট পাওয়া গেল। ঘোলা জল, তাতে চরও বিস্তর পড়েছে। নদী অনেকগুলো ধারায় বইছে। একজন মাঝিকে পেলাম, তিনি টিনের নৌকা চালান। তাঁর সঙ্গে কথা বলে আমরা নৌকাতে বসলাম। বিজনৌর থেকে যতটা দক্ষিণে নামা যায় আমরা যাব। অতএব নৌকাটা ভাড়া নিলাম। চার-পাঁচ কিলোমিটার নিচের দিকে নেমে গেলাম। ওদিকে পার ভাঙছে। মাঝে চর। সেখানে আমরা নেমে ছবি তুললাম। জলের নমুনা সংগ্রহ করা হল। বিকেলের দিকে যখন ঘাটে ফিরলাম, বহু লোক সেখানে জমে গেছে। তারা এপার-ওপার হয় এই নৌকায়। আজ সেটা আমাদের দখলে! ওপারে নেমে আট-দশ কিলোমিটার হাঁটলে মুজফফরনগর যাওয়া যায়। তবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও কেউ কোনো ক্ষোভ প্রকাশ করল না। আমরা জল থেকে নামছি, আমাদের জিনিসপত্র নামানো হচ্ছে। কিছু লোক নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, ‘ইয়েলোগো কো তো অব কাম করনা পড়েগা। মোদিজি আয়ে হ্যাঁয়, ব্যাঠকে রোটি খায়েঙ্গে অ্যায়সা তো চলেগা নহীঁ।’ আমরা আর কী বলব! লোকজন আমাদের কিছু কাঁকুড় খেতে দিল।
আবার সেই হেঁটে ফেরা। জানা গেল, নিজামতপুরার দিকে গেলে একটা স্কুলবাড়ি গোছের কিছু পাওয়া যাবে। খিদে পেয়েছে। চিঁড়েভাজা সঙ্গে ছিল, খেলাম। জলটা ফুরিয়ে গিয়েছিল। পাশে আখের খেতে একজন কাজ করছিল। আমাদের কাছে এসে পরিচয় করল। ওর নাম নীরজ আগরওয়াল। ও বেরিলীতে কাজ করে। গ্রামেরই ছেলে, এখন আখের মরসুমে বাবাকে সাহায্য করার জন্য গ্রামে এসেছে। বেরিলী কলকাতার মতো একটা বড়ো শহর। ও আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকল। গ্রামের বাইরে একটা মন্দির আছে। তার পাশে আমরা তাঁবু খাটিয়ে নিলাম। গ্রামের মধ্যে গঞ্জ-বাজার, সেখানে আমরা বাজার করলাম। জিনিসপত্র নিয়ে এসে আমাদের স্টোভে রান্না করে খাওয়াদাওয়া করলাম।
সকালবেলা বেরোবো। দেখি নীরজ একটা ছোটো বালতির আধ-বালতি দুধ নিয়ে এসেছে। নতুন মোষ হয়েছে। ফুটিয়ে দিল, খেয়ে নিলাম। এদের মধ্যে যেমন স্বাভাবিক আতিথেয়তা রয়েছে, তেমনই রয়েছে ধর্মীয় উন্মাদনা। কাছাকাছি মুজফফরনগর হওয়ায় আড্ডার মধ্যেই ওই ধরনের কথাও উঠে আসছে। কারা ওখানে প্রথম আক্রমণ করেছিল, আবার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কাদের হয়েছে, ইত্যাদি। এসবে কিছু উল্লাস আছে, আবার এক ধরনের অনুতাপও আছে। যাই হোক, গাড়ি ধরে বিজনৌর ফিরে এলাম।
মোরাদাবাদ এসে রাতের গাড়ি ধরে কানপুরের উদ্দেশ্যে চললাম। হরিদ্বার থেকে বিজনৌর ৯০ কিলোমিটার, বিজনৌর থেকে কানপুর চারশো কিলোমিটারের কিছু বেশি। মাঝে কনৌজ, সেখানে কল-কারখানা তেমন নেই। এখানে নদী এতবার দিক পরিবর্তন করছে যে নদী স্থিতিশীল হয়নি। রাত তিনটেয় কানপুর পৌঁছালাম। এখানে এসে নদী আর ছড়িয়ে না পড়ে কিছুটা সংযত হচ্ছে। যথেষ্ট নোংরা শহর। সভ্যতার যতরকম জঞ্জাল জড়ো করা হয়েছে। গঙ্গার উদ্দেশ্যে এগোলাম। সরসৌয়া ঘাট, পর্যাপ্ত টাকাপয়সা দিয়ে একটা নৌকা নিলাম। ছয় কিলোমিটার নদীর বুকে আমরা জলের নমুনা সংগ্রহ করলাম। নদীর মাঝখানে জায়গায় জায়গায় চর পড়েছে। একদিকে কানপুরের ট্যানারি শিল্পের বর্জ্য, তারপর শহরের নিকাশি-নালার বর্জ্য নদীর মধ্যেই ফেলা হচ্ছে, তৃতীয়ত পূণ্যস্থানের জঞ্জাল। এখানে সাফাই অভিযান চলছে। আমরাও তাতে সামান্য অংশ নিলাম। ঠিকা সাফাই কর্মীরা আমাদের সরকারের লোক ভেবে একটা অনুরোধ করলেন, আমরা যেন সরকারকে ওদের স্থায়ী করে দেওয়ার সুপারিশ করি। আমরা শুনলাম। সেদিনই সন্ধ্যের গাড়ি ধরে এলাহাবাদ চলে এলাম। ২০০ কিলোমিটার রাস্তা।
এলাহাবাদ বা কানপুরে তাঁবু খাটানোর ব্যাপার নেই। হোটেলই ভরসা। পরদিন সকালে বেরোলাম। এলাহাবাদের ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যমুনার ওপর সরস্বতী ঘাটে রয়েছে নেভাল এনসিসি-র স্থায়ী আস্তানা। ওদের কাছে রিপোর্ট করা ছিল। সেখান থেকে বোট নিয়ে আমরা সরস্বতী ঘাট থেকে সঙ্গম অবধি গেলাম। গঙ্গার তুলনায় যমুনার জল পরিচ্ছন্ন। যমুনার গতিপথও ছোটো। সঙ্গমে প্রচুর পাখি আছে। গঙ্গা, যমুনা এবং সঙ্গমের জলের নমুনা নেওয়া হল। বিকেলে নদীর পার বরাবর হেঁটে গেলাম। সঙ্গম থেকে এক-দেড় কিলোমিটার হেঁটে গঙ্গার ওপর একটা ব্রিজ আছে। ওই অবধি গেলাম। এখানে একটা মেলাতে কোটি কোটি লোক জড়ো হয়। এত বড়ো একটা শহরে স্থায়ী শৌচাগার এবং নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে সরকারকে আরও ভাবতে হবে। এত বিস্তৃত চর যদি শৌচাগার হয়ে ওঠে, তাহলে সেটা খুবই বিশ্রী। আমার সামনেই এক বাস ভর্তি লোক এসে তাদের মাথা কামিয়ে চুলগুলো নদীতে বিসর্জন দিয়ে গেল। নদী এত পীড়ন কী করে সয়! পরদিন ফেরা।