- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

কোচবিহারে মঞ্চস্থ হলো বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জীবন নিয়ে নাটক ‘মহাজনের নাও’

রামজীবন ভৌমিক, কোচবিহার, ২৮ আগস্ট#

ঈশ্বরকে আমি মনে করি একটা পেঁয়াজ, খোসা ছিলতে গেলে নিরন্তর তা ছেলা যায়, হঠাৎ একসময়ে দেখি তা শূন্য হয়ে গিয়েছে
আব্দুল শাহ করিম

২৩ থেকে ২৬ আগস্ট অনীক আয়োজিত গঙ্গা যমুনা নাট্যোৎসব ২০১৩ অনুষ্ঠিত হল কোচবিহার রবীন্দ্রভবনে। সংগঠক আইপিএ ও অগ্নি নাট্যসংস্থা, কোচবিহার। শেষদিন বুধবার পরিবেশিত হল বাংলাদেশের সুবচন নাট্যসংস্থার নাটক ‘মহাজনের নাও’। নাট্যকার শাকুর মজিদ, পরিচালক সুদীপ চক্রবর্তী। নাট্যদলে তরুণ অভিনেতা অভিনেত্রীদের প্রাধান্য। তারুণ্য স্ফুরিত হৃদয় ঢালা অভিনয়ের সাক্ষী রইল কোচবিহারবাসী। নাটক প্রায় এক ঘন্টা দেরিতে শুরু হয়েছিল। দর্শক বেশ বিরক্তই হচ্ছিল। নাটকের শুরুতে বিসমিল্লা-আলহামদুলিল্লা শব্দগুলি সুরে সুরে রবীন্দ্রভবনের আনাচ-কানাচ ভরিয়ে দর্শকদের স্পর্শ করল। নিমেষে সব বিরক্তি শুষে নিল সমবেত সুর। সব দর্শক স্থির মূর্তির মতো বসে বিরতিহীন ১ ঘন্টা ৫০ মিনিটের নাটকে হারিয়ে থাকল। মঞ্চ জুড়ে অভিনেতারা এবং একজন অভিনেত্রী — প্রায় প্রত্যেকেই গান গেয়ে দর্শকের দৃষ্টিকে একটি ফোকাসে নিবদ্ধ করছে। কিছু বোঝা যাচ্ছে না — নাটকটা ঠিক কী? কোন দিকে যাচ্ছে? কিছুক্ষণ পর, একটু একটু করে বোঝা গেল, কোনো এক ব্যাক্তিজীবনের যাপন নিয়েই নাটক। বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের জীবনসংগ্রামের ঘটনা।

মহাজনের নাও নাটকের দৃশ্য মোবাইলে তোলা।
মহাজনের নাও নাটকের দৃশ্য। ছবি আবু সৈয়দ চৌধুরি।

নাটকে বাউলসম্রাটের জীবন সংগ্রামের বিভিন্ন দিককে চিত্রিত করা হয়েছে। নাটকের শুরুর দিকে দেখা যায়, আব্দুলকে গ্রাম-পরিবার ছেড়ে যেতে বাধ্য করে মুসল্লীদের অত্যাচার। মুসল্লীরা মসজিদে নামাজের পর করিমের বে-শরিয়তি কাজ কারবার বন্ধ করবার ফরমান জারি করে। করিম সারিন্দাকেই জীবনের শুরু আর শেষ জ্ঞান করে গ্রাম ছাড়ে। নাটকের একেবারে শেষ দৃশ্যে আব্দুল করিম মারা যায়। প্রচুর জনসমাগম হয়। ওই একই মসজিদের মুসল্লীরা জানাজার ব্যাবস্থা করে। একবারে বসবার স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় দু-বার জানাজা পড়া হয়। এই মসজিদেই আব্দুলের স্ত্রী সরলার মৃত্যুর পর আব্দুলের কাতর প্রার্থনা সত্ত্বেও, এই মুসল্লীরাই জানাজা পড়তে অস্বীকার করেছিল।

নাটকে উঠে এল, করিমের গান বাংলাদেশের বিবাহ প্রেম বিরহ থেকে সব আনন্দ উৎসবের অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ। জনসেবা থেকে সরকারি অনুষ্ঠান, সবেতেই করিমের গান। বঙ্গবন্ধু থেকে মৌলানা ভাসানী — সকলের উপস্থিতিতেই সকলকে ছাপিয়ে আব্দুল করিম জনগণের কাছের মানুষ, হৃদয়ের মানুষ। নাটকে আমরা করিমকে সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশায় কাঁদতে দেখি, প্রতিবাদ করতে দেখি গানের কলি দিয়েই। রাজনৈতিক নেতাদের রোষ আর প্রলোভনকে সহজেই পাশ কাটিয়ে, মানুষের ওপরে অত্যাচারের আর শোষণের বিচার চাইতে দেখি। হিন্দু মুসলমান হানাহানিতে ব্যাথিত হয়ে করিম গান ধরেন — ‘গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান/ মিলিয়া বাওলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম’।

মাত্র ১ ঘন্টা ৪০ মিনিটে প্রায় ৮৫ বছরের যাপিত আপোষহীন দৃঢ় জীবনকাহিনী হাজির হয় আমাদের সামনে। অভিনেতা অভনেত্রীদের সুরেলা কন্ঠ নিখুঁত পারস্পরিক বোঝাপড়ায় মঞ্চ ভাগ করে নেওয়া দেখবার মতো। মঞ্চসজ্জার কথা আলাদা করে বলতেই হয়। সামান্য উপকরণকে ব্যবহার করে অসামান্য অনুভূতি-অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন মঞ্চসজ্জাকারী। গোটাকয়েক (৪ থেকে ৫টি) ছোটো ছোটো বাক্স, একটি ময়ূরের মুখোশ, বাঁশের খাঁচায় ব্যাটারি চালিত হ্যাজাক, কয়েকটি কাঠের শক্তপোক্ত বৈঠা আর দুটো সাদা কাপড় দিয়ে পুরো মঞ্চের সাজ। সাথে সামান্য লাইট। একটি বড়ো সাদা কাপড়ের মাঝখানে প্রায় দেড় ফুট ব্যাসার্ধের ফাঁকা জায়গা। চারদিকে সূতোর কাজ করা এই ফাঁকা জায়গাকে করিম আর সরলার প্রেমদৃশ্য রূপায়ণে অভাবনীয় দক্ষতায় ব্যাবহার করা হয়েছে। সাদা পর্দার উপর গোলাপী আলোর আভা আর পর্দার মাঝখানে বৃত্তাকার ফাঁকা জায়গার মধ্যে দিয়ে উঠে আসা সরলা-করিমের আলিঙ্গন দৃশ্যকে অনেকদিন ভুলতে পারবে না কোচবিহারের দর্শকেরা।

অনুষ্ঠানে আরও কয়েকটি নাটক হয়, আইপিএ-এর বাইপ্রোডাক্ট (নাট্যকার ও পরিচালক পূর্বাচল দাশগুপ্ত) এবং অগ্নি নাট্য সংস্থার অমানিশা (নাট্যকার ও পরিচালক অর্ণব মুখোপাধ্যায়) এবং অনীক-এর দুটি নাটক, অ্যাডভেঞ্চার এবং তপতী (পরিচালক মলয় বিশ্বাস)।