- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

কেমন চলছে অনলাইন ক্লাস – সহকর্মীদের কাছে খোঁজখবর নেবার পর

নিমগ্ন বিশ্বাস। শান্তিপুর। ১৬ জুলাই, ২০২০।#

বিভিন্ন ক্ষেত্রের মত শিক্ষাক্ষেত্রও আজ বিপন্নতার সম্মুখীন। নিকট ভবিষ্যতে বিদ্যালয়গুলিতে স্বাভাবিক পড়াশুনা শুরু করার কোনো আশাই যেখানে দেখা যাচ্ছেনা, সেখানে অনলাইন পড়াশুনো হয়তো সেই নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’র মত অবস্থা। কিন্তু কানামামার সুযোগটাই বা কতজন পাচ্ছে! অথবা সেই সুযোগের সদব্যবহার বা কতজন করছে? – সে বিষয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু শিক্ষক শিক্ষিকার সাথে কথা বলা গেল। তাদের অভিজ্ঞতার নিরিখে এই বিষয়টিকে একটু বুঝবার চেষ্টা করাই এই লেখার উদ্দেশ্য। যে শিক্ষক শিক্ষিকাদের সাথে কথা বলা গেল তাদের একটা অংশ প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলিতে কর্মরত। অপর অংশ শহরতলির বিদ্যালয়গুলিতে। তাদের প্রায় সকলেরই অভিমত তারা অনলাইনের মাধ্যমে কাজটা শুরু করেছিলেন মূলত দুটি দৃষ্টিভঙ্গী থেকে। প্রথমত, যখন ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি পড়ানোর সুযোগ নেই, তখন তাদের কিছুটা সক্রিয় রাখা। পাঠক্রমকে কিছুটা হলেও এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দ্বিতীয়ত, যখন তারা ঘরে বসে বেতন পাচ্ছেন, সেদিক থেকেও আত্মবোধের জায়গা থেকে নিজেদেরকে কিছুটা স্বচ্ছ রাখা। তাদের উদ্দেশ্য মূলত এক হলেও অভিজ্ঞতা কিন্তু এক নয়।

এই শিক্ষকদের কেউ কেউ ব্যবহার করছেন ‘হোয়াটস অ্যাপ’ গ্রুপ, কেউ বিদ্যালয়ের ফেসবুক পেজ। অথবা ইউটিউবে আপলোড করছে। জুম অ্যাপকে কাজে লাগিয়েছেন কয়েকজন। প্রযুক্তিনির্ভর এই শিক্ষাব্যবস্থাতে বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষকদের মধ্যেই এর ব্যবহার সম্পর্কে অস্বচ্ছতা ছিল। ধীরে ধীরে তারা সেই সংকট কাটাবার চেষ্টা করেছেন। যারা প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলিতে কাজ করেন তারা এই প্রযুক্তিনির্ভর পড়াশুনোয় ৩০-৩৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীদের যুক্ত করতে পেরেছেন, কেউ কেউ আবার দু’একজনকে। এইসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের নিম্নবিত্ত অনেক পরিবারেই স্মার্ট ফোনের সুবিধা নেই। অথবা কিছু পরিবারে থাকলেও সেগুলি বাড়ির বড়দের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়, ফলে লাইভ ক্লাসের নির্দিষ্ট সময়ে সেইগুলি ছাত্রছাত্রীরা পায়না। আবার প্রচন্ড দারিদ্র যখন এইসব পরিবারগুলিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে, তখন ইন্টারনেটের জন্য খরচ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। এই কথা মাথায় রেখে শিক্ষকরা কোনো পাঠ্যাংশকে অবলম্বন করে তাদের পড়ানো (মূলত লেকচার মেথডে) হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে বা ফেসবুক পেজে আপলোড করছেন। শিক্ষক মাত্রই আশা করেন ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রতিক্রিয়া জানাবে অথবা প্রশ্ন করবে। কিন্তু সেই প্রতিক্রিয়া খুব কম অথবা কোথাও কোথাও নেই বললেই চলে। যদিও সেইসব শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বিদ্যালয়ের ক্লাসেও যে তারা ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রচুর প্রতিক্রিয়া পান এমনটা নয়। কিন্তু সেখানে যেহেতু সরাসরি তাদের সাথে যুক্ত হতে পারেন তাই নানা কৌশল অবলম্বন করে তাদের সক্রিয় করে তোলেন। শিক্ষকদের ভালোবাসা ও উৎসাহদানে কাজও হয় অনেকটা। কিন্তু প্রযুক্তিনির্ভর এইধরনের পড়াশুনায় সে সুযোগ অনেক কম। তবে শহরতলীর বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা কিছুটা অন্যরকম। তারা কিছুটা বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে এই ব্যবস্থায় যুক্ত করতে পেরেছেন। কিন্তু সেখানেও একটা বিরাট সংখ্যক ছাত্রছাত্রী বাইরেই থেকে যাচ্ছে। এসব জায়গায় কখনও কখনও ‘লাইভ ক্লাস’ চালানোও সম্ভব হয়েছে। প্রতিক্রিয়া সামান্য বেশি। তবে বেশিরভাগ প্রতিক্রিয়াই ‘ওকে স্যার’, ‘ঠিক আছে ম্যাডাম’ -এই গোত্রের। কিন্তু প্রশ্ন করার পরিমাণও যে সেখানে খুব বেশি তেমন নয়। যারা লাইভ ক্লাস করাচ্ছেন, তারা পড়ানোর ফাঁকে হালকা চালের কথা বলে কিছুটা একঘেয়েমি কাটানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেখানেও মাঝে মাঝে কিছু ছাত্রছাত্রী গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।

কচিকাঁচাদের জায়গায় বন্ধ ক্লাসরুমে জায়গা করে নিয়েছে চারাগাছ। দেখেছেন দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার একটি স্কুলের শিক্ষক দেবরাজ নাইয়া।

কিন্তু একটি বহুল প্রচারিত কর্পোরেট কাগজের সম্পাদকীয় কলম এই ব্যবস্থাকে ‘শাপে বর’ বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাদের সমীক্ষা ভিত্তিক এই সম্পাদকীয়’র মূল কথা, আমাদের সামনে শিক্ষাব্যবস্থার নতুন দিগন্ত যেন খুলে গেছে। বিদ্যালয়গুলি যে ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে এতদিন চলছিল তা যেন যাদুকাঠির স্পর্শে অনেকটাই বদলে গেছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? এই সম্পাদকীয় পড়তে গিয়ে মনে হয় এই সমীক্ষা ঘরে বসে বানানো অথবা প্রত্যন্ত অঞ্চলের নয়। শহরের বিদ্যালয়গুলিকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবে যারা অনলাইনে শিক্ষাদানের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন, তাদের অনেকেই ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে যথাযথ মাত্রায় প্রতিক্রিয়া না পেয়ে এবং অধিক সংখ্যক ছাত্রছাত্রীকে এই ব্যবস্থায় যুক্ত করতে না পেরে বেশ হতাশ। অনেকে এখনও এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষাদান চালিয়ে গেলেও তাদের গতি কিছুটা হলেও শ্লথ।

তবে কি আমরা থেমে যাব? না। প্রযুক্তিকে অবশ্যই কাজে লাগাতে হবে। তবে সেই সুযোগ যেন প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর কাছেই পৌঁছে যায়। সেজন্য রাষ্ট্রের একটা গুরুদায়িত্ব রয়েছে, রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া, প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর। কারণ নিম্নবিত্ত পরিবারগুলিতে এই প্রযুক্তির সহায়তা পাবার জন্য প্রয়োজন যে একটি ইলেকট্রনিক্স গ্যাজেটের, তা সংগ্রহ করা এখনও বেশ কঠিন। বিশেষ করে এই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় তা আরো কঠিন। তাই এই ব্যবস্থার শিক্ষাদানে প্রদীপের তলায় অন্ধকারই থেকে যাচ্ছে। বর্তমান কোভিদ পরিস্থিতির মত অচলাবস্থায় এ ব্যবস্থা কিছুটা সহায়তা দিলেও তা কখনো শিক্ষাদানের বিকল্প স্থায়ী সমাধান হতে পারেনা। অন্তত বিদ্যালয়-শিক্ষার ক্ষেত্রে তো নয়ই। কারণ বিদ্যালয় শুধু পাঠক্রমিক শিক্ষাই দেয়না, তা বেঁধে বেঁধে থাকার শিক্ষাও দেয়।