- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

কেবেকে শিক্ষা-ঋণে জর্জরিত ছাত্রদের তিনমাস ব্যাপী আন্দোলন পাশে দাঁড়াল কানাডার নাগরিক সমাজ

মূলত ফরাসি ভাষাবলম্বী মানুষের বসবাস কানাডার কেবেক অঞ্চলে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু করে টানা তিনমাস ধরে প্রায় ১,৭৫,০০০ ছাত্রছাত্রী (যারা মূলত কেবেক অঞ্চলের বাসিন্দা) প্রতিবাদ আন্দোলন করছে। ওখানকার আঞ্চলিক ও জাতীয় সংবাদমাধ্যম তাদের এই আন্দোলনকে বিকৃত রূপ দেওয়ার জন্য এবং এর প্রাপ্য গুরুত্ব থেকে বঞ্চিত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে তার স্বভাবসিদ্ধ চতুরতা সম্বল করে। তাদের আন্দোলনের দাবির গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো এর ফলে নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। ৭৫% বৃদ্ধি পাওয়া টিউশান ফি-র বিরুদ্ধে আপাতভাবে শুরু হয়েছিল যে প্রতিবাদ তা আসলে বৃহত্তর একটি সমস্যার কথা তুলে ধরে। টিউশান ফি আসল সমস্যা নয়। আসল সমস্যা হল ছাত্র-ঋণ।
যারা বলছে, কেবেকের ছাত্রছাত্রীরা কানাডার অন্যান্য অঞ্চলের ছাত্রদের থেকে অনেক কম মাইনে দেয় অতএব তাদের মাইনে-বৃদ্ধি সম্বন্ধে কোনো প্রতিবাদ করা উচিত নয়, তারা সম্ভত জানে না যে ছাত্রঋণও নেয় তারা অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের অর্ধেকেরও কম। একজন স্নাতক কানাডিয়ান ছাত্রের গড় বাৎসরিক মাইনে ৫০০০ ডলার এবং ঋণের পরিমাণ ২৭০০০ ডলার। কেবেক অঞ্চলের স্নাতক ছাত্রদের সেখানে বার্ষিক মাইনে গড়ে ২৫০০ ডলার এবং ঋণের পরিমাণ ১৩০০০ ডলার। অতএব মাইনে বাড়লে ঋণের পরিমাণও স্বভাবতই বাড়বে। অদূর ভবিষ্যতে সম্ভাব্য সুদ বৃদ্ধি ও চাকরির বাজারের হতাশাজনক অবস্থার প্রেক্ষিতে ছাত্রদের আন্দোলনে সামিল হওয়াই কি সঙ্গত নয়? শুধু কেবেক নয়, কানাডার ছাত্রসমাজের একটা বড়োসড়ো সমস্যার জায়গা হল এই ঋণ।
কানাডার ৬০% ছাত্রছাত্রীরা গড়ে ২৭০০০ ডলারের ঋণের বোঝা কাঁধে করে স্নাতকস্তরের পরীক্ষা পাশ করে। ৭০% চাকরির ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর শিক্ষার প্রয়োজন। আর ১৮ বছরের মধ্যে ৪ বছরব্যাপী স্নাতকোত্তর পড়ার খরচ ৫৫০০০ ডলার থেকে বেড়ে ১০২০০০ ডলার হয়ে যাবে কানাডায়। এ হেন অবস্থায় কানাডার ছাত্রেরা তাদের মা বাবার উপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে ক্রমশ। ৪০% স্নাতক ছাত্রছাত্রী ঋণের চাপে কোনোরকম বড়ো বিনিয়োগ করতে পারছে না। এক চতুর্থাংশেরও বেশি পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে আত্মীয়স্বজনদের সাথে থেকে টাকা জমাতে শুরু করে দিয়েছে। কানাডার বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীই তাই এই বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত।
কেবেকে শুরু হওয়া বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন দমন করার জন্য সরকার ১৮ মে একটি জরুরি বিল পাশ করে, যার নাম বিল-৭৮। সেই বিল-৭৮ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংলগ্ন এলাকায় ৫০ জনের বেশি লোক মিলে কোনোরকম জমায়েত করা, প্রচার করা বা বিক্ষোভ দেখানো চলবে না। মতপ্রকাশের অধিকার হরণকারী অগণতান্ত্রিক এই কালা-কানুনের বিরুদ্ধে কানাডা দেশটির রাজধানী মন্ট্রিয়ালে প্রায় ৫০,০০০ লোকের মিছিল হয়। তারা খোলাখুলিভাবে বিল-৭৮ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের সাথে দেখা করে আলোচনায় বসতে সম্মত হননি একবারও। তাঁর পদত্যাগের দাবিও তোলে মিছিলে আসা ছাত্র, শিক্ষক ও সাধারণ নাগরিকেরা। ক্রমাগত অসংখ্য গ্রেপ্তার, লাঠিচার্জ, রবার বুলেট সহ্য করেও ঝিমিয়ে পড়েনি এই ছাত্র আন্দোলন। বরং এই দমনের ও বিল-৭৮-এর বিরুদ্ধে তাদের পাশাপাশি সোচ্চার হয়ে ওঠে সাধারণ নাগরিকেরা। যারা শিক্ষাক্ষেত্রে মাইনেবৃদ্ধি সম্বন্ধে নির্লিপ্ত ছিল, তারাও এই নয়া আইনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের সাথে রাস্তায় নেমেছে। অবিচ্ছিন্নভাবে এখনও চলছে এই আন্দোলন।

চুর্ণী ভৌমিক, কলকাতা, ২৭ মে। ছবি ইন্টারনেটের সূত্রে পাওয়া