- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

কুণালদা চলে গেলেন

শান্তনু চক্রবর্তী, কলকাতা, ১৩ জুন#

kunal
কুণাল গুহ রায় (৮ ডিসেম্বর ১৯৫৬ — ৬ জুন ২০১৪)

শমীক ‘অবিচুয়ারি’ লিখতে বলেছিল। কিন্তু অবিচুয়ারি লিখতে অনেক ‘তথ্য’ লাগে। কুণালদা সম্পর্কে অনেক ‘তথ্য’ আমার জানা নেই। বরং যে কুণাল গুহ রায়-কে দেখেছি চিনেছি তার সম্পর্কে একটু লিখি।
সমাজকর্মী ও পরিবেশকর্মী হিসেবে কুণাল গুহ রায়ের ভূমিকা নিয়ে দীর্ঘ রচনার সুযোগ আছে। টালিগঞ্জের অশোকনগর বাজারকে প্রোমোটারের থাবা থেকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে নাগরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, ‘স্বভূমি’-র উপর বেআইনি ভাবে নির্মাণের বিরুদ্ধে মামলা, পশ্চিমবঙ্গের বিপন্ন জলাভূমি বাঁচাতে জনস্বার্থ মামলা, তপন দত্তর খুনের যথার্থ তদন্তের স্বার্থে সিবিআই তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে মামলা, এই সবের ক্ষেত্রে কুণাল গুহ রায়ের অবদান অনেকেই জানেন। সে নিয়ে আর কখনও আলোচনা করা যাবে।
সমাজকর্মী, পরিবেশকর্মী এবং জোরালো রাজনৈতিক মতামতের মানুষ কুণাল গুহ রায়কে কাছ থেকে চিনতাম। কিন্তু যাঁকে ভালোবাসতাম, তিনি এসব ছাপিয়ে আরও একজন কেউ: বন্ধু কুণালদা। ইনি অক্লেশে আমাদের জীবনে ও হৃদয়ে অনেকটা জায়গা দখল করে বসেছিলেন। কারণ অজানা নয়। কুণালদা ভালোবাসতে জানতেন। ভালোবাসা প্রকাশ করতে জানতেন। অন্যের ভালোবাসার কদর করতে জানতেন। মানুষের নানান গুণ ও হৃদয়বৃত্তির দাম দিতে জানতেন। বন্ধুদের তো বটেই, স্বল্প-পরিচিতের বিপদেও অকাতরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারতেন। নিজের সময় ও শক্তি অন্যের প্রয়োজনে খরচা করার ক্ষেত্রে কোনো কার্পণ্য করতেন না। বস্তুত, কার্পণ্য তাঁর ধাতে ছিল না। টাকার বড়ো অভাব ছিল। অনেক সময় সিগারেটটা কিনতেও ঘনিষ্টদের কাছে হাত পাততে হত। কিন্তু যখনই হাতে কিছু টাকা থাকত, অন্যের প্রয়োজনে দেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধা করতেন না। হাসিমুখে আনন্দের সঙ্গে নিজেকে উজাড় করে দিতে পারা দেখে হতবাক হয়ে যেতাম।
অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার আর একটা দিক ছিল তাঁর সাহস। আঞ্চলিক কায়েমি স্বার্থ ও তাদের মস্তান বাহিনী থেকে শুরু করে খোদ রাজ্যস্তরে শাসক দলের শত্রু হিসেবে চিহ্ণিত হয়েছেন কুণালদা। কিন্তু তা নিয়ে তাঁকে বিশেষ তোয়াক্কা করতে দেখিনি। ভয় কখনও পেতেন না তা নয়। সাবধানতা অবলম্বন করার গুরুত্বও বুঝতেন। কিন্তু ভীরুতা একেবারে ছিল না। ছিল না পিছিয়ে আসার মনোবৃত্তি। সরকার যখন সরকার-বিরোধী প্রচারকে স্তব্ধ করতে মোবাইল কোম্পানিকে দিয়ে অনেকের মোবাইলের সিম স্তব্ধ করে দিল, তখন একমাত্র কুণালদাই মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে হাই কোর্টে মামলা করলেন। সরকারপক্ষ ভয় পেল। মামলার শুনানির আগের দিন সিম চালু হয়ে গেল। কিন্তু কুণালদা ছাড়লেন না। মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপ ও হয়রানির শাস্তি ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে মামলা চালালেন। মামলা জয়ের দিকে এগাচ্ছিল। কিন্তু পরিণতি দেখে যাওয়ার সুযোগ আর তাঁর ঘটল না। (বাদীপক্ষের অনুপস্থিতিতে সে মামলা হয়ত এবার শেষ হয়ে যাবে।)
তাঁর এই মামলাটি লড়ছিল হাইকোর্টের তরুণ উকিল বিক্রম ব্যানার্জি। কম কথা বলে। নিজের আবেগ প্রকাশে খুব দড় নয়। কুণালদা মারা যাওয়ার পরে বেশ কয়েকদিন ফোন করল: ‘শান্তনুদা, খুব আপসেট লাগছে’। অনেকের মতো ওর জীবনেও কুণালদা অনেকটা জায়াগা দখল করে বসেছিলেন।\par
দাহ করে বেরিয়ে ফেরার সময় রূপম চট্টোপাধ্যায় কুণালদাকেই ফোন করতে যাচ্ছিল। আসলে কেওড়াতলা থেকে ফিরছে তো, হাতে কিছু সময় আছে, কুণালদার সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে নিলে হত। ‘কুণালদা বড্ড বেশি আমাদের অভ্যেসের মধ্যে ঢুকে রয়েছেন’, বলল রূপম।
এভাবে এত তাড়াতাড়ি চলে গেলেন কুণালদা! আর যে দেখা হবে না। আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে যে।