- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

কীভাবে আমি জৈবচাষে এলাম : চন্দ্রপ্রসাদ অধিকারী

৯ এপ্রিল বর্ধমান জেলার জামালপুর ব্লকের অমরপুর গ্রামে অমরপুর বিমলা কৃষি বিদ্যালয়ে ‘শিয়ালি ফার্মার্স ক্লাব’-এর উদ্যোগে সারাদিন ব্যাপী এক আলোচনাসভার আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই বিদ্যালয়ে সাধারণ পড়াশুনার সঙ্গে কৃষি একটা বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়। এলাকার কৃষিব্যবস্থার উন্নতির জন্য এই বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। এবছর ১৭৯ জন ছাত্র উচ্চ-মাধ্যমিকে কৃষি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছে। সভায় শুরুতেই নেপাল থেকে আগত জৈবচাষি চন্দ্র প্রসাদ অধিকারীকে তাঁর চাষের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলতে বলা হয়। এখানে তা প্রকাশ করা হল। #

আমি নেপালের চিতওয়ান জেলার শ্রীপুর গ্রাম থেকে এসেছি। খুব ছোটোবেলায় আমি চাষের কাজ শুরু করেছি। চাষির ঘরের ছেলে, বাবাও চাষ করতেন। ১৯৭৬ সালে যখন আমি চাষ শুরু করলাম, তখন নেপালে সবুজ বিপ্লবের ধারণা এসেছে। সরকারও সাহায্য করছে। আমিও অন্যদের মতো রাসায়নিক চাষ শুরু করলাম। প্রথমে ভালোই ফসল হচ্ছিল। সাত-আট বছর পর থেকে সমস্যা শুরু হল। টমাটোর ভিতর পোকা ঢুকে ডিম পেড়ে সব ছারখার করে দিত। জমিতে পোকামাকড়ের ছত্রাকের সমস্যা লেগেই থাকল। উৎপাদনও কমতে শুরু করল। মাটি এত শক্ত হয়ে গেল যে কাজ করা কঠিন হয়ে গেল। লেবার বেশি লাগত। প্রতি বছর চাষে খরচ বাড়তে থাকল। এইভাবে আমি পনেরো বছর টানলাম। তারপর ১৯৯১ সালে ঠিক করলাম, না, রাসায়নিক চাষ আর করব না। ছোটোবেলায় খেতে আলু দেখলে নিয়ে এসে পুড়িয়ে খেতাম। এত ভালো টমাটো হত যে আমরা খেত থেকে পেড়ে খেয়ে নিতাম। তখন রাসায়নিক প্রয়োগ হত না। রাসায়নিক প্রয়োগের ফলে আমাদের ঝিঙের ফলন বন্ধ হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, বাবা-মায়ের সময়ে যখন রাসায়নিক সার-খাদ না দিয়ে ভালো ফলন হয়েছে, এখন কেন হবে না?
আমি জৈব চাষ শুরু করলাম। আমার স্ত্রী চাষের কাজে সমান উদ্যোগী। তিনি বললেন, তুমি এই পথে যেও না, সবাই যা করছে তুমিও তাই করো। আমি ওঁর কথা শুনলাম না। প্রথম বছর ফলন বেশ কম হল। আমার স্ত্রী তা দেখে আরও চটে গেলেন। তবু আমি লেগে রইলাম। দ্বিতীয় বছরে ফলন একটু ভালো হল। তৃতীয় বছরে আমার ফলন যথেষ্ট ভালো হল।
নেপালে ‘ইনসান’ বলে জৈব চাষের একটা পুরোনো সংস্থা আছে। আমি ওদের কাছে গেলাম। সেখানে প্রশিক্ষণ নিলাম। ওরা পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আমিও ওদের কাছ থেকে শিখলাম।
প্রথমে গ্রামে আমি একাই জৈব চাষ করতাম। অন্যদের বললে বলত, হ্যাঁ এটাই ঠিক রাস্তা। কিন্তু তারা রাসায়নিক প্রয়োগ করেই চাষ চালিয়ে যেত। আমাদের গ্রামে জেলার সরকারি দপ্তর চাষিদের দুটো গোষ্ঠী তৈরি করেছিল। এই দুটো গোষ্ঠীকে ডেকে বসে বারো বছর আগে আমরা ‘নেপাল এগ্রিকালচারাল প্রোডিউসার্স কো-অপারেটিভ’ তৈরি করলাম। এর আগে জৈব চাষ হত, কিন্তু নেপালে কোনো জৈব সমবায় ছিল না। দু-বছর লাগল রেজিস্ট্রেশন পেতে। প্রথমে ২৬ জন চাষি এতে যোগ দিল, ৪ জন মহিলা আর ২২ জন পুরুষ। এরপর ‘ভিলেজ ডেভেলপমেন্ট কমিটি’র সভা ডাকা হল। সবাই মিলে পরিকল্পনা তৈরি করল যে পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের গ্রামকে জৈবগ্রাম হিসেবে গড়ে তোলা হবে। কিন্তু বাস্তবে কিছু হল না। যাই হোক, পাঁচজন চাষি জৈব চাষ করতে রাজি হওয়ায় তাদের পাঠানো হল ‘ইনসান’-এ। ওরা প্রশিক্ষণ নিয়ে আসার পর তিনজন পিছিয়ে গেল। দুজন জৈব চাষ শুরু করল। আজ ১২৭টি চাষির পরিবার এই কো-অপারেটিভের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ৮৩ জন মহিলা আর ৪৪ জন পুরুষ। আমাদের ওখানে মেয়েরাই চাষের কাজ বেশি করে। যুবকেরা চাকরির কাজে যুক্ত হয়ে যায়। যারা দেশে কাজ পায় না, তারা পয়সা খরচ করে সৌদি আরব, দুবাই, মালয়েশিয়া ইত্যাদি অন্যান্য দেশে চাকরি করতে চলে যায়।
আমরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছি। ধানখেতের মধ্যে মাছের চাষ করা হচ্ছে একই সঙ্গে। মাছের জন্য ওই খেতের মধ্যেই নালা কাটা হয়েছে। ১ কাঠা জমিতে ২০০ কেজি ধান হচ্ছে, সঙ্গে ১০-১৫ কেজি মাছও হচ্ছে। ধান বিক্রি করে ৪০০০ টাকা আয় হচ্ছে, মাছ বিক্রি করে আরও ৩০০০ টাকা পাওয়া যাচ্ছে। গমের খেতে একই সঙ্গে লাগানো হচ্ছে মটর। মটর শাক থেকে নাইট্রোজেন পাচ্ছে গম গাছ। ফুলকপি আর ধনে লাগানো হচ্ছে একসঙ্গে। তাতে ফুলকপিতে পোকা লাগার উপক্রম কমছে। পরপর এক এক সারিতে গাজর, বীন, রসুন, টমাটো, ভুট্টা লাগানো হচ্ছে। আলুতে আগে ধসা রোগ লাগত। আমরা দেখলাম, দু-মাস আগে লাগালে সেটা আটকানো যাচ্ছে। আশ্বিনের শেষে আলু লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তেমনি টমাটো লাগানো হচ্ছে দু-মাস পরে, ফাল্গুনের প্রথমে।