- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

কবির সমাধিতে একদিন

৩০ জানুয়ারি, জিতেন নন্দী, দিল্লি#

ছবি জিতেন নন্দীর তোলা।
ছবি জিতেন নন্দীর তোলা।

রবিবার আমরা দিল্লির কয়েকটা পুরাতাত্ত্বিক (প্রত্নতাত্ত্বিক) স্মৃতিসৌধ দেখতে গিয়েছিলাম। দিল্লিতে ইতিমধ্যে তালিকাভুক্ত তিন শতাধিক স্মৃতিসৌধ রয়েছে। লোকে সাধারণত এর মধ্যে গুটিকয়েক দেখতে যায়, যেমন কুতুব মিনার, হুমায়ুনের সমাধি, লাল কেল্লা ইত্যাদি। আমরা গিয়েছিলাম দক্ষিণ দিল্লির দিকে। ওখানে পাশাপাশি দুটো এলাকা, কুতুব এলাকা এবং মেহেরৌলি-তে বেশ কিছু স্মৃতিসৌধ ও পুরাকীর্তি রয়েছে। প্রথমে গেলাম কুতুব মিনারে। শীতের সকালেও ওখানে বেশ ভিড়। দশ টাকার টিকিট কেটে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া সংরক্ষিত এই চত্বরে ঢুকতে হল। এই এলাকার ঐতিহাসিক নাম হল লাল-কোট দুর্গ। পুরোনো সাতটা শহর নিয়ে আজকের দিল্লি। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হল লাল-কোট। তোমার বংশীয় গুর্জর (রাজপুত) শাসক অনঙ্গপাল এই শহর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ৭৩১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। এই এলাকার মধ্যে রয়েছে কুয়াতুল-ইসলাম মসজিদ (অর্থাৎ ইসলামের শক্তি), কুতুব মিনার, কুতুবউদ-দিন আইবক-এর নাতি শামসুদ্দিন ইলতুতমিশ (১২১১-৩৬)-এর সমাধি, আলাঈ মিনার, আলাউদ-দিন-এর সমাধি এবং মাদ্রাসা। শোনা যায় কুতুবউদ-দিন মাত্র চারবছর রাজত্ব করেছিলেন। ১২১০ সালে লাহোরে পোলো খেলতে গিয়ে তিনি মারা যান। ১১৯৩ সালে তিনি কুতুব মিনারের নির্মাণকার্য শুরু করেন। তাঁর মৃত্যুর পরে ইলতুতমিশ এবং তারপর ১৩৬৮ সালে ফিরোজ শাহ তুঘলক মিনারের সর্বোচ্চ পঞ্চমতলা নির্মাণ করেন। এই দীর্ঘ সময় জুড়ে  এই এলাকায় বেশ কিছু সৌধ ও সমাধি নির্মিত হয়। এরই মধ্যে রয়ে যায় প্রাচীন কিছু ভগ্নাবশেষ এবং পুরাকীর্তির চিহ্ন। যেমন, রয়েছে একটি লোহার স্তম্ভ। এর ওপর রয়েছে চতুর্থ শতকের গুপ্তযুগের সংস্কৃত লিপিতে কিছু খোদাই করা লেখা। সেই লেখা থেকে অনুমান করা হচ্ছে এটি একটি বিষ্ণু ধ্বজা। তবে এই এলাকায় চতুর্থ শতকের অন্য কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। অতএব অনুমান করা হচ্ছে যে অন্যত্র থেকে এটা এখানে আনা হয়েছিল।

কুতুব এলাকার কাছেই মেহেরৌলি এলাকা। এখানেই রয়েছে ২০০ একরের বেশি জমির ওপর মেহেরৌলি আর্কিওলজিকাল পার্ক। এগারো শতকে দ্বিতীয় অনঙ্গপাল তাঁর রাজধানী লাল-কোট থেকে সরিয়ে নিয়ে যান কনৌজ-এ। ১২ শতকে পৃত্থীরাজ চৌহান তাঁকে পরাস্ত করে লাল-কোট দুর্গ দখল করেন এবং এই এলাকাকে আরও কিছুটা বিস্তৃত করে তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। তিনি এই নতুন এলাকা ঘিরে একটা বিশাল প্রাচীর নির্মাণ করেন, রাই পিথোরা কেল্লা। আমরা সেই কেল্লায় গিয়ে দেখলাম সহজেই সেখানে যাওয়া যাচ্ছে, কোনো টিকিট নেই। প্রাচীর বরাবর হেঁটে কিছুটা গেলাম। নিরাপত্তারক্ষীদের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে প্রাচীরের ওপারে রয়েছে জঙ্গল। প্রাচীরের সামনে রয়েছে একটা শুকিয়ে যাওয়া লম্বা নালা।

এরপর আমরা প্রবেশ করলাম মেহেরৌলি আর্কিওলজিকাল পার্কের ভিতর। এত বড়ো কিছুটা অবিন্যস্ত এই বাগানের ভিতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে একশোর বেশি সৌধ। প্রথমে দেখলাম গিয়াসুদ-দিন বলবান-এর সমাধিস্থল। কিছুটা গিয়ে পেলাম জামালি-কামালি-র মসজিদ এবং সমাধি। জামালি ছিলেন একজন সন্ত এবং কবি। তাঁর পোশাকি নাম ছিল শেখ ফজলুল্লাহ, জালাল খান নামেও তাঁকে ডাকা হত, ডাকনাম জামালি। উর্দুতে জামাল শব্দের অর্থ সুন্দর। শোনা যায় যে তিনি দিল্লির সুলতান সিকান্দার লোদির (১৪৮৯-১৫১৭) শিক্ষক ছিলেন। পরে তিনি সুলতানের সভাসদ হয়েছিলেন। লোদি বংশের রাজত্বের পর মুখল সম্রাট বাবর এবং হুমায়নের সময়েও জামালি জীবিত ছিলেন। তাঁর মসজিদ নির্মাণ হয়েছিল ১৫২৮-২৯ সালে। ১৫৩৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয় এবং সমাধি নির্মিত হয়। জামালির সমাধির পাশেই রয়েছে কামালি-র সমাধি। ঐতিহাসিকভাবে কামালির পরিচয় পাওয়া যায়নি। তবে কথিত রয়েছে যে কামালি ছিলেন জামালির বন্ধু এবং গুণগ্রাহী। শুনতে পেলাম যে জামালি কামালি মসজিদে রয়েছে ফার্সি ভাষায় খোদিত জামালির কবিতা। আমরা সেটা দেখিনি। তবে শুনলাম তিনি লিখেছিলেন, ‘আমার শরীর তোমার পথের ধূলোয় ঢাকা’।

এই চত্বরেই রয়েছে পাথরে বাঁধাই করা বেশ ক-টি কুয়ো। এর মধ্যে একটা গন্ধক-কি-বাওলি, আর একটা রাজোঁ-কি-বাওলি। রাজোঁ শব্দের অর্থ হল রাজমিস্ত্রি। এই কুয়োটি ধাপে ধাপে গভীরে নেমে গেছে। পাঁচতলা বাড়ির মতো ভাগ করা, প্রতিটি তলায় রয়েছে চারপাশ দিয়ে বারান্দা এবং তার ভেতরে অনেকগুলি ছোটো ছোটো ঘর। আবার একদম ওপরে একপাশে রয়েছে গোলাকার একটা কুয়ো, আরও গভীর। আমাদের পাঁচতলা বাড়ির চেয়েও অনেক উঁচু এই কুয়ো। বাগানের মধ্যে রয়েছে নালা এবং জলাশয়। পুরো এলাকাটাই জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে রাস্তা, তবে ভুলভুলাইয়ার মতো, দিক-নিশানা পাওয়া যায় না।

প্রতিটি এলাকায় এইসব কুয়ো দেখে বেশ কৌতুহল জাগে মনে। পরে একদিন গেলাম নিজামুদ্দিন আউলিয়া-র দরগায়। সেখানেও কুয়ো রয়েছে। কীরকম মনে হয় যে রাজা-রাজড়ারা যুদ্ধ করেছে, রাজ্য দখল করেছে। আর এইসব সাধু-সন্ত-কবিরা শুধু কবিতাই লেখেননি, শুধু গানই করেননি, পাশাপাশি তাঁদের একটা সামাজিক ভূমিকা ছিল। সেই সামাজিক কাজের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কুয়ো খনন, জলাশয় নির্মাণ।