- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

এক ডজন ওয়ার্ডের কাহিনি : বইমেলা

ছন্দা বাগচী, কলকাতা, ২৩ ফেব্রুয়ারি#

২০১৪ কলকাতা বইমেলার ছবি উইকিমিডিয়া থেকে
২০১৪ কলকাতা বইমেলার ছবি উইকিমিডিয়া থেকে

পরিবর্তনের বাংলায় প্রতিবারের মতো এবারও বারে বারে থমকে যেতে হচ্ছিল রাস্তা জুড়ে পরিবর্তনের ধাক্কায় — ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের ভোল পাল্টাতে বইমেলা সংলগ্ন রাস্তা জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ির জেরে অনর্থক দড়ি খাটিয়ে সঙ্কীর্ণ করে তোলা এবড়ো খেবড়ো ফুটপাথ ধরে হোঁচট খেতে খেতে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে শেষে রেলিং-ভাঙা ভূগর্ভ-পথ দিয়ে কোনোক্রমে বইমেলার তোরণদ্বারে পৌঁছিয়ে হাঁফ ছাড়ার অভিজ্ঞতা গতবারের মতোই অপরিবর্তিত! যেতে আসতে কানে এসেছে জনতার টুকরো মন্তব্য,  ‘রাস্তাটা আগের মতোই আছে’। ‘খোঁড়াখুঁড়ি শেষ হবে কবে?’  ‘আরে মশাই, শেষ হলে তো হয়েই গেল, কর্মযজ্ঞ যতদিন দেখানো যায়’। ‘এদের শুরু আছে, শেষ নেই’, ইত্যাদি। ভাবে বোঝা গেল, বইমেলা আন্তর্জাতিকতার শিরোপা পেলেও এখানে যাওয়া আসার পথ নিয়ে না রাজ্য সরকারের মাথাব্যাথা আছে, না পুরসভার। ভেতরেও একই দশা। ধুলোয় মাখামাখি চত্বরে নিয়মিত জল ছেটানোর তাগিদ নেই। স্টলের বিন্যাসও ক্রমিক সংখ্যানুরূপ নয়। গাইড ম্যাপ-ও অসম্পূর্ণ। সবই কেমন যেন অগোছালো।
তবে পুলিশ, দমকল সহ সরকারের সব পরিসেবাকে টেক্কা দিয়ে টয়লেট পরিসেবায় কলকাতা পুরসভার পাওনা ফুল মার্কস — মানলেন অনেকেই। তবুও এর চেয়ে যে মইয়দানের বইমেলা অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল সন্দেহ নেই। মিলন মেলার হট্টমেলাতেও অবশ্য নামি-অনামি নানান প্রকাশনীর ছড়াছড়ি। কিন্তু বইমেলায় ক্রেতার চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি বলে যারা টিপ্পনী কাটে, তারা ভুলে যায়, সাধ যতই থাক্‌, দামের আগুনে পছন্দসই বইয়ের দিকে হাত বাড়ানোর সাধ্য সবার থাকে না বলেই অনেকেই নতুন বইয়ের গন্ধ শুঁকেই তৃপ্ত। ইদানীং খাবারের দামও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় ভোজনরসিকরাও খুব স্বস্তিতে নেই। বইমেলায় চা-কফির দাম শুনেই তাদের চক্ষু চড়কগাছ। সরকারি জলের প্যাকেট ফেটে নাস্তানাবুদ কেউ কেউ। তবে কম খরচে চিকিৎসার টানে হোমিওপ্যাথি বইয়ের স্টলে ক্রেতাদের আনাগোনা বেড়েছে বলেই মনে হল। ভিড় উপচে পড়ছে নানা রাজ্যে পর্যটন-ভিত্তিক বই-পুস্তিকার স্টলে, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারই নিজভূমে ব্রাত্য। তবে বইমেলায় এবারের থিম পেরুর প্যাভিলিয়ন নিয়ে কৌতুহলের খামতি নেই। ভিড় টানছে প্রতিবেশি বাংলাদেশও। কলকাতা পুলিশের স্টলে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের অস্ত্র প্রদর্শন আর বম্ব স্কোয়াডের ডেমনস্ট্রেশন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু!
রাজনৈতিক স্টলের মধ্যে প্রথমেই নজর কাড়ে রাজ্যের শাসক দলের কার্পেট মোড়া সুউচ্চ মণ্ডপ। এক দর্শনার্থীর সরস মন্তব্য, ণ্ণজাগো বাংলা’ না হয়ে বঙ্গেশ্বরী নামকরণ হলে নাকি ভালো মানাত। কারণ দলের নেত্রী ছাড়া আর কারোর লেখা বইপত্রের চিহ্ন নেই। এমনকী, ণ্ণসেরা মমতা’ বইটিও নিজের ঢাক পেটানো’র বাংলা প্রবাদ স্মরণ করায় — জানালেন মণ্ডপ ফেরত আরেক দর্শনার্থী। তুলনামূলক বিচারে নিষ্প্রভ বাম যুব সংগঠনের স্টলে ক্রেতার চেয়ে ক্যাডারের সংখ্যাধিক্য বাম জমানার মতোই! তবে চ্যাপলিন সিনেমা হলের আদলে তৈরি কেন্দ্রের প্রধান শাসক দলের স্টলটিকে আদৌ কোনো রাজনৈতিক দলের স্টল বলে মনে হয় না, বরং ফিল্মি পত্রিকার প্যাভেলিয়ান ভাবা যেতে পারে। ঢোকার মুখেও পুরোনো বাংলা সিনেমার নানা দৃশ্য নিয়ে প্রদর্শনী। দেশে জাতীয়তাবাদী নেতা-মনীষী-স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এত বাড়ি-ঘর-স্মৃতিসৌধ থাকতে প্রদেশ কংগ্রেসের কেন চ্যাপলিন হলের কথা মনে হল, কেনই বা বাঙালির নস্টালজিয়া মনে করাতে তারা চলচ্চিত্রের দ্বারস্থ হলেন, বোধগম্য হল না! আরও দুর্বোধ্য, স্টলে জাতীয় কংগ্রেসের মুখপত্রের অনুপস্থিতি, অথচ সম্পূর্ণ ভিন্ন মতাবলম্বী মহাশ্বেতা সুমনদের লেখালেখির সমাদর যা গতবারেও চোখে পড়েছিল! কেন্দ্রীয় সরকারের অবদান ণ্ণতথ্যের অধিকার আইন’ প্রসঙ্গে প্রচারপত্র বিলি আর দেশাত্মবোধক গানের অনুষঙ্গ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হলেও নানান কালজয়ী সাহিত্য সংগ্রহের পাশাপাশি ভিন্নতর যৌনতা আর প্রকৃতিবিরোধী সম্পর্ক নিয়ে লেখা বইয়ের সহাবস্থান শতাব্দীপ্রাচীন রাজনৈতিক দলের স্টলে শুধু বেমানান নয়, আমার মনে হয় দৃষ্টিকটুও।
বামপন্থী চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটাতে পটু কিছু ছোটো পত্রপত্রিকার দেখা মিলল লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভিলিয়নে। তবে বেশিরভাগ ছোটো কাগজই ণ্ণসংবাদ মন্থন’-এর মতো দলীয় সংকীর্ণতার গলি-খুঁজিতে পা রাখতে চায় না। মূলত সংবাদ আর সাহিত্য নির্ভর এসব পত্রপত্রিকার টেবিলের সামনেই তাই উৎসাহী ক্রেতার ভিড়। বড়ো কাগজ আর বৈদ্যুতিন মাধ্যমের চটকদার প্যাভিলিয়নে হরেক কনটেস্ট আর ফটো সেশনের টানে কৌতুহলী দর্শকের সমাগম যথেষ্ট, আবার এরই মধ্যে দক্ষিণবঙ্গে প্রায় অমিল উত্তরবঙ্গ সংবাদ-এর স্টলে তিন দিনের পুরোনো কাগজও বিকোচ্ছে দেদার! বিক্রেতাদের অত্যুৎসাহ লক্ষ্যণীয় হলেও পাঠ্যবইয়ের ক্রেতার সংখ্যা কি কমছে ইন্টারনেটের দৌলতে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই পা রাখলাম অজস্র প্রকাশনী আর বহুজাতিক সংস্থার প্রচারপত্র মাড়িয়ে বাইপাস পেরোনোর ভূগর্ভ-পথে। যেখানে সরস্বতী পুজোর দিন বই না ছোঁয়ার প্রাচীন সংস্কার ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বই-পাগলদের রীতিমতো জনারণ্য!