- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘এই লাইনের দু-নম্বরটা যেন আমার বাড়ির কাজে যায়’

শাকিল মহিনউদ্দিন, কলকাতা, ১৮ অক্টোবর#

ছবি কল্পিত।
ছবি কল্পিত।

সকাল সাতটা, বজবজ লাইনের সন্তোষপুর স্টেশন। ইঞ্জিনের ভারী শব্দ আরশি ভেদ করে না। বেশ শক্তপোক্ত করে আঁটা। বেলা গড়ালেও বলা যায় ‘সুপ্রভাত’। তাই তাড়া নেই বাবুদের। সূর্য মাথায় উঠুক, মাথায় আছে ছাতা। ঝক্কি শুধু শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরা। একটু পড়িমরি করে ছোটা। সকালটা যে ওদের জন্য নয়।

সকাল তাদের, খিদের আরশিতে যাদের নাড়ি দেখা যায়। জঠরের জ্বালা আর বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তারা ভিড় করেছে ১নং প্ল্যাটফর্মে। সাতসকালেই থিক থিক করছে অগুনতি মাথা। এ মাথারা প্রতিদিনের হিসেব করে। ওদের স্বপ্নের রেশ কেটেছে অনেক আগেই। এখন পরখ করে বাস্তবকে।

দৃষ্টি ফেলতেই চোখ জুড়ে যায় রঙিন রোশনাইয়ে। ঢাকাই, জামদানি পরা বাবুদের বাড়ির মহিলারা নয়। রঙিন কমদামি ঝকঝকে সিল্ক পরা, জমকালো সব রঙ — কারণ সাদামাটা রঙ চোখকে টানে না। ঝলমল করছে সারা প্ল্যাটফর্ম। মনে হতে পারে যেন রঙের বিজ্ঞাপন চলছে। বিপণি সাজানো মলের বিজ্ঞাপন, কাঁচের বাইরে থেকেও চোখ ঝলসে যায়, মন টানে। বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ে স্বল্পবাস রমণী, চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। সঙ্গে বাঁকা চাহনি, মুচকি হাসি আর নিষ্ঠুর আবেদন — মনটা ছোঁক ছোঁক করে। সবটাই আছে এখানে। অন্তত স্নো-পাউডার-লিপস্টিকে চেষ্টা করা হয়েছে। পার্থক্যও আছে — বিকিনির বদলে এগারো হাত। বেশ আব্রু রক্ষিত। তবে আশপাশ থেকে উঁকি দিয়ে যায় দৃষ্টিসুখ।

বছর পঁয়ত্রিশের হাসিনা। ষোলোবিঘার রেললাইনের পাশেই ঝুপড়ি-ঘর। বর্ষায় থৈ থৈ শীতে উঁকি দিয়ে যায় কুয়াশা। হাসিনা রঙ-মিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করত। কর্মসূত্রেই অনেকের পরিচিত সে। স্বামী পরিত্যক্তা। স্বামীর রেখে যাওয়া ঘরেতেই সে থাকে দুটি ছেলেমেয়ে নিয়ে। তাদের পেট পালতেই সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে সে। কথায় কথায় জানায় :

— আমরা রঙের কাজ করি। ঠিকেদার কালোমিস্ত্রির হেল্পার।

— শুধু কি রঙের কাজ?

— অফার এলে রঙে রঙ মেলানো হয়।

— বুঝতে পারলাম না।

জবাব না দিয়ে সে হাসে। হাসিটাই জবাব। হাসি থামিয়ে বলে —

— সবই কালোমিস্ত্রির জোগান গো। বোঝনি?

— তাহলে ফুলে প্রজাপতির ব্যবস্থা করা নাকি?

— হ্যাঁ, বাবুরা রঙ চায়, রঙিনও হতে চায়। মিস্ত্রিকে ডেকে বলে, আমার বাড়িটা নতুন, ডাগরডোগর চাই বুঝলি।

এক মাঝবয়সি বাবুকে বলতে শুনেছি — ‘এই লাইনের দু-নম্বরটা যেন আমার বাড়ির কাজে যায়।’ বাবুর ফরমাস, মিস্ত্রি পালন করে।

জাহানারা, মীরা, রসিদা, লক্ষ্মী, আজমিরা, প্রতিমারা রঙের কাজ করে। সুযোগ এলে মানুষকে রঙিন করার কাজও করে। কর্ম ও ক্ষণিক আনন্দে তারা টিকে থাকে।

সকলে কাজে চলে যাওয়ার পর হাসিনা একটু ফ্রি হয়। আনমনে বলে ফেলে — ‘যাও যাও খুব মৌজ করো। তোমরাও একদিন ছিবড়ে হবে। শেষটাতে হিসেব মিলবেনি গো’ হাসিনার কাছে ওর কথা আরও জানতে চাইলে ওর দৃষ্টি চলে যায় রেললাইনের আঁকাবাঁকা পথ ধরে দূরে। ও হাতড়াতে থাকে পিছনের দিনগুলোকে।

খুনসুটি, মশকরা আর রঙিন গল্পে পার হত দিনগুলো। রাতে শুয়ে শুয়ে বুনতাম স্বপ্নের জাল। কত রাত নিমেষে কেটে যেত। টেরও পেতাম না। চোখের পাতা বুজতে না বুজতেই সকাল। নতুন ঘরে হবু স্বামীর বাহুবন্ধনে ঢলাঢলি করব, দারুণ আনন্দ হবে! সে আসবে, কখনও হামা দিয়ে, কখনও গুটিসুটি পায়ে। এলও তাই। কিন্তু আকবর বেইমানি করল আমার সঙ্গে।

স্বপ্নচোরেরা আসে জানান দিয়ে, তাদের ঠেকানো বড়ো দায়। পলকা ডাল মটকে পড়ে। সুখের প্রতিশ্রুতি টেকে না। হাসিনার জীবনের সুখের সময় তাই পলকেই হারিয়ে গেল। আলো-আঁধারের গোধূলি লগ্নে বিধ্বস্ত হয়ে ফেরাই হাসিনাদের নিয়তি। দিশাহীন পথে বেহিসেবি যাত্রা।

— ওর মন পেতে নিজেকে নিংড়ে দিয়েছি। তবু পেলাম না …

হাসিনার কণ্ঠ ফেঁসে আসে। চোখ ভরে যায় জলে। ভিজে কাপড় বারবার নিংড়ালে যেমন রঙ চটে যায়, হাসিনাদের উদ্ভিন্ন যৌবনের ভরা বসন্ত তেমনি হেমন্তের রিক্ত শূন্যতায় ভরে উঠল। সবুজ সতেজ পাতারা দেহতরু থেকে শুকনো বিবর্ণ হয়ে খসে খসে দূরে বহুদূরে ছড়িয়ে পড়ল। হাসিনা এখনও অনুযোগের আঙুল তোলে।

— মদ্দ মানুষের ইচ্ছার ওপর তো আমাদের জোর খাটে না। তক্ক করি, গাল পাড়ি। শেষমেষ হেরে যাই। ধরে রাখতে পারলাম না। মদ, জুয়া আর অন্য মেয়েমানুষের টান আমাদের জীবনের অভিশাপ।

স্বামীহীন সংসার নিয়ে পরিত্যক্তা নারী ভোগের সামগ্রী। তাই পাঁচজন টানাটানি করে। সেই পাঁচমিশেলি অভিজ্ঞতায় ওরা আজ বেশ টনটনে। তার স্পষ্ট ছাপ ওদের কথাবার্তায়, চালচলনে বিনা পয়সায় মিস্ত্রিরা মশকরা মারলে সুদ সমেত ফেরত দেয় ওরা — ‘শালা তোর মা বোনকে …’।

দিনের শেষে ছেলেমেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর হাসিনা ভাবতে থাকে সেই পুরোনো কথা। তার বাবামায়ের কথা। ওরা পড়াশুনা শেখাতে চেয়েছিল হাসিনাকে। খুব বেশিদূর হয়নি। আট ক্লাসে গিয়ে দাঁড়ি টানতে হয়েছে। অভাব বস্তুটা পিছু ছাড়েনি। বছর দুয়েক ঘরে বসে থাকার পর বিয়ে। এইসব সাতপাঁচ ভাবনায় রাত গড়াতে থাকে। হাসিনা জেগে জেগে দেখে হাজার ফুটো তার ঘরের চালে। সেই ফুটো দিয়ে জ্যোৎস্নার আলো ঢুকে আসছে তার শরীর-মনে। সেই অস্ফুট আলোয় হাসিনা ঘরের দেওয়ালে আকবরের ছায়া দেখে। আকবর কি তাকে শুধু ঘরটাই দিয়ে গেছে? আর কিছু দেয়নি? সুখের প্রতিশ্রুতি তো দিয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি এখনও বুকে ধরে রেখেছে হাসিনা। সে জানে আকবর ফিরবে, ফিরবে তার হাসিনার কাছে। অন্ধকার ঘরের ভিতর একটা জোনাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাঁদের জ্যোৎস্নার সাথে জোনাকির আলোয় ঘরের দেওয়ালে আকবর আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে হাসিনার রাতজাগা চোখে। চোখ ভরে সেই ছবি সে দেখতে থাকে। পাশের জানলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয় ভোর।