- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

উত্তরাখণ্ড জুড়ে বড়ো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিই প্লাবনে সাধারণের ক্ষতি বাড়িয়েছে

শ্রীমান চক্রবর্তী, ২৯ জুলাই, গুপ্তকাশী#

ল্যানকো কোম্পানির জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পাহাড় চিরে বানানো টানেল, মন্দাকিনীর ধারা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। ফাটা, ২৭ জুলাই. ছবি শমীক সরকার
ল্যানকো কোম্পানির জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য পাহাড় চিরে বানানো টানেল, মন্দাকিনীর ধারা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। ফাটা, ২৭ জুলাই. ছবি শমীক সরকার

২৬ জুলাই ভোরে দুন এক্সপ্রেস থেকে হরিদ্বারের আগে জ্বোয়ালাপুরে নেমে ক্রান্তিকারী মজদুর সংগঠনের অমিত কুমারের বাড়িতে কিছু সময় কাটিয়ে ভোরেই গুপ্তকাশীর উদ্দেশ্যে রওনা দিই। সাথী হয় কাটোদরের পঙ্কজ ভাই। পথে যেতে যেতে কথা হচ্ছিল কেদারনাথের এই ভয়াবহতা সম্পর্কে। এর আগে অমিত কুমার বলছিলেন জুন মাসের ওই প্লাবনের পর অনেকগুলি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার বেশ কয়েকটি চালু হয়েছে। সেদিনের সেই বানে বেশ কতগুলি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। অমিত কুমার জানালেন উত্তরাখণ্ডে বিভিন্ন স্থান জুড়ে বড়ো বড়ো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলিই এই জলপ্লাবনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়েছে। রুদ্রপ্রয়াগ থেকে যখন অগস্ত্যমুনিতে আমরা ট্রেকারে করে যাচ্ছি, তখন থেকেই ভালো ভাবে আমাদের কেদারনাথের বানের ধ্বংসলীলা চোখে পড়তে শুরু করল।
পঙ্কজ ভাইয়ের সাথে কথা বলে প্রথমে মনে হচ্ছিল যে এখানে বড়ো বড়ো জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি নিয়ে সাধারণ মানুষ ওয়াকিবহাল নয়। কিন্তু রুদ্রপ্রয়াগ থেকে অগস্ত্যমুনি যেতে যেতে আমাদের সাথে বাসে আলাপ হয় কেদারঘাটির কেন্দ্রীয় সরকারি রক্ষী জি এস নোটিয়ালের সাথে। অগস্ত্যমুনি পৌঁছে আবার গাড়িতে করে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। হেঁটে যেতে যেতে কথায় কথায় নোটিয়াল জানিয়েছিল যে কেদারনাথের এই ধ্বংসলীলার বেশ বড়ো একটা কারণ জলবিদ্যুতের জন্য বানানো বড়ো বড়ো টানেল, আর পাহাড় ফাটানোর জন্য ব্যবহৃত ডিনামাইট বা আরডিএক্স। কারণ এই ব্লাস্টগুলির ফলে পাহাড়গুলি অনেক জায়গায় আলগা হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যাচ্ছে। গুপ্তকাশী থেকে ফাটা যাওয়ার পথে একটা ধ্বংস হওয়া ল্যানকো কোম্পানির টানেল চোখে পড়ল। যন্ত্রপাতি সব ভেসে গেছে, ফাঁকা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একজন বেসরকারী নিরাপত্তা রক্ষী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আশপাশ জুড়ে রয়েছে বীভৎস ভূমিক্ষয়ের চেহারা। নিচের দিকে একটা সেতুও ভেঙে পড়েছে। নিরাপত্তা রক্ষীর কথায় জানা গেল প্রচুর মেশিন বানের জলে আর ভূমিক্ষয়ের সাথে তলিয়ে গেছে। পথে আসতে আসতে পাহাড়ের ওপর থেকে অনেক জায়গায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য তৈরি হওয়া বাঁধগুলির ভগ্ন অবস্থা বেশ কয়েক জায়গায় চোখে পড়ল।
ধানী গ্রামের শিব সিং পাটোয়ার জানালেন যে ফাটার ওপরে একটা টানেল গেছে। এই টানেলটা প্রায় ৯ কিমি লম্বা। উনি কথায় কথায় জানালেন যে বাঁধগুলির কারণে অনেক ক্ষতি বেড়ে গেছে। টানেল কাটার জন্য কোম্পানির লোকেরা ডিনামাইট ব্যবহার করে। প্রচণ্ড আওয়াজের সাথে আশেপাশের ৪-৫ কিমি পাহাড়ের বুকে গ্রামগুলো কেঁপে ওঠে। শিব সিং জানান, কোম্পানি অনেককে টাকা দেয়, তাই কেউ কিছু বলে না। শিব সিংয়ের ছেলে অনিল জানায়, কোম্পানি এখানকার ছেলেদের চাকরি দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। যেসব গ্রামে ওরা বাঁধ বানানোর কাজ করে সেখানকার অল্প কয়েকজনকে কাজ দিলেও অধিকাংশ কিছু কাজ পায় না। পেলেও বহু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা রক্ষীর কাজ। অনেককে ওরা কাজে নিয়ে বসিয়ে রাখে কোনো কাজ না দিয়ে, আবার অনেককে কয়েক মাস পরে ছাড়িয়ে দেয়।
নাগরিক পত্রিকার সম্পাদক মুনিশ আমাদের জানান, কয়েক দিন আগে সীতাপুরের কাছে বিধ্বস্ত বাঁধ সরেজমিনে দেখেন। ওপরের দিক থেকে নদীর জলস্তরের অনেক ওপরে রয়েছে টানেলের মুখ, যেখান দিয়ে জল যাবে গতিতে বিদ্যুৎ তৈরির জন্য। মুনিশ এরপর নদীর উল্টোদিকে নিচের দিকে দেখেন নদীর জলস্তর বাড়ানোর জন্য তলা থেকে কংক্রিটের কয়েক মিটার লম্বা ও চওড়া গাঁথনি তোলা হয়েছে। এর ফলে নদীর ওই মুখটি সরু হয়ে গেছে। কেদারনাথের বানের সাথে জলের চাপ এইখানে প্রচণ্ড বেড়ে যায় এবং ভূমিক্ষয় বাড়িয়ে প্রচণ্ড মাত্রায় ধ্বংসলীলা চালায়। মুনিশ জানান, বিষয়টা বুঝতে তিনি ল্যানকো কোম্পানির জিএম-এর সাথে দেখা করেন। তিনি বিশেষ কিছু বলতে না চাইলেও একথা জানান এখানকার সমস্ত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উৎপাদন শুরু হলে ৮৮ শতাংশ বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলি নিজেরা বিক্রি করতে পারবে, আর ১২ শতাংশ তারা সরকারকে দেবে। মুনিশ জানালেন এই প্রকল্পগুলির থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ অন্যত্র বিক্রির জন্য করা হচ্ছে। আর ধ্বংস করা হচ্ছে এখানকার পাহাড়ের পরিবেশ, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ। বিপন্ন হয়ে পড়ছে পাহাড়ের জনজীবন। তিনি এখানে ছোটো ছোটো মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা জানালেন। তিনি জানালেন বহু জায়গায় বাঁধের কারণে ভূমিক্ষয় যেমন বেড়েছে, তার সাথে বেড়েছে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি। কোম্পানিগুলি নিজেদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য পাথর কাটার মেশিন ব্যবহার করে না। খরচ কমানোর জন্য ওরা বড়ো বড়ো বিস্ফোরণ ঘটায়, যাতে সুড়ঙ্গপথ খোদাইয়ের সময় কমানো যায়। ধানি গ্রামের যুবক অনিলও ওই একই কথা বলছিল।

ল্যানকো কোম্পানির জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের টানেল গেছে বাড়ির নিচ দিয়ে। আর বাড়িতে ধরেছে ফাটল। খাড়াই গ্রামের ছবি। মেখন্ডা মাল্লা গ্রামেও সব বাড়ির একই দশা। ২৮ জুলাই। ছবি শ্রীমান চক্রবর্তীর তোলা
ল্যানকো কোম্পানির জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের টানেল গেছে বাড়ির নিচ দিয়ে। আর বাড়িতে ধরেছে ফাটল। খাড়াই গ্রামের ছবি। মেখন্ডা মাল্লা গ্রামেও সব বাড়ির একই দশা। ২৮ জুলাই। ছবি শ্রীমান চক্রবর্তীর তোলা

ফাটার খারাই গ্রামের একেবারে ওপরের দিকের বাসিন্দা দিওয়ান সিং রানা তাঁর ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে কথা বলতে বলতে জানালেন তাঁর বাড়ির ঘর ও উঠানের তলা দিয়ে টানেল গেছে। এর আগে ল্যানকো কোম্পানির টানেল বানানোর সময় বিস্ফোরণ ঘটালে তাঁর নতুন বানানো ঘরের দেওয়াল ও ছাদের ঢালাইয়ে চিড় ধরে। জানলা দরজা আলগা হয়ে যায়। তিনি জানালেন কোম্পানির কর্মরত কর্মচারীদের কিছু বলতে গেলে তারা বলে, সরকার অনুমতি দিয়েছে, আমরা কিছু জানি না। অনেকবার এরকম ঝামেলা হওয়ায় ওরা কম তীব্রতার বিস্ফোরণ ঘটায়। তবে তাও সাময়িক।
ফাটার কাছে মাখন্ডা মাল্লা গ্রামের লীলাদেবী, লাক্কি লাল, বৃজ লাল প্রমুখরা জানান, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য যে ৯ কিমি দীর্ঘ টানেল তৈরি হয়েছে তার সূত্রপাত হয়েছে তাদের গ্রামের ওপরের পাহাড় থেকে। গত জুনের জলপ্লাবনে বহু জায়গায় ধসের কারণে টানেলের অংশ নষ্ট হয়েছে। তাঁদের কথায় প্লাবনের পর কোম্পানির লোকজন সবকিছু ছেড়ে চলে যায়, এদিকে গ্রামের তলা দিয়ে যে টানেল গেছে তার মধ্য দিয়ে এখন আর কোনো জল সরবরাহ হচ্ছে না। গ্রামের ছেলে ছোকরারাও আমাদের নিয়ে দেখায় যে কীভাবে টানেল বানানোর জন্য পাহাড়ের নিচের অংশের মাটি-পাথর কেটে ফেলায় ওপরের অংশ কমজোর হয়ে পড়ে এবং বৃষ্টির জল পড়ে ওপরের পাহাড় নরম হয়ে গিয়ে বহু জায়গা ধসে পড়েছে। ভূমিক্ষয়ের মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়।

ল্যানকো কোম্পানির টানেল খুঁড়ে বের হওয়া পাথরের স্তুপ রাস্তার পাশেই জমে। এইরকম জমে থাকা পাথরের স্তুপ নদীতে গিয়ে মিশে নদীখাত উঁচু করে দিয়ে মেঘভাঙা বৃষ্টিতে নদীকে কোথাও কোথাও ১০০-২০০ ফুট অবদি উঁচু করে দিয়েছিল বিপর্যয়ের দিন। শমীক সরকারের তোলা ছবি। ২৭ জুলাই।
ল্যানকো কোম্পানির টানেল খুঁড়ে বের হওয়া পাথরের স্তুপ রাস্তার পাশেই জমে। এইরকম জমে থাকা পাথরের স্তুপ নদীতে গিয়ে মিশে নদীখাত উঁচু করে দিয়ে মেঘভাঙা বৃষ্টিতে নদীকে কোথাও কোথাও ১০০-২০০ ফুট অবদি উঁচু করে দিয়েছিল বিপর্যয়ের দিন। শমীক সরকারের তোলা ছবি। ২৭ জুলাই।

গ্রামবাসীরা আরও জানায় যে টানেলের খুঁড়ে বের হওয়া মাটি পাথর তারা আশে পাশেই জমিয়ে রাখে পাহাড়ের কোনো কোলে, যে মাটি বর্ষার জল পেয়ে নিজের ওজন বাড়িয়ে জলের ধারার সাথে ভারী আকারে নিচে নামে। উত্তরাখণ্ডের বহু স্থানে এইভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত মাটি পাথর জলের স্রোতের সাথে নদীর মধ্যে পড়ে নদীর গভীরতা কমিয়ে দেয়। একসাথে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টির জল, গান্ধী সরোবরের জল, নদীর ভূমিক্ষয়ের বিশাল পরিমাণ মাটির সংযোগে জলপ্রবাহের স্তর যেমন বাড়ায় তেমনি তার ঘনত্ব বৃদ্ধির ফলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে মন্দাকিনী, অলকানন্দা, কালীগঙ্গা ধ্বংস যজ্ঞ চালাতে পারে।

ল্যানকো কোম্পানির বানানো মন্দির। এভাবে মন্দির বানিয়ে দিয়ে গ্রামের লোকেদের খুশি করে কোম্পানি। ছবি শমীক সরকারের তোলা। ২৮ জুলাই
ল্যানকো কোম্পানির বানানো মন্দির। এভাবে মন্দির বানিয়ে দিয়ে গ্রামের লোকেদের খুশি করে কোম্পানি। ছবি শমীক সরকারের তোলা। ২৮ জুলাই

মাখান্ডা গ্রামের বাসিন্দারা জানায়, প্রথমে ল্যানকো কোম্পানির তরফে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল গ্রামবাসীদের — কম্পিউটার সেন্টার, হাসপাতাল, ছেলেদের চাকরি সহ নানাকিছু। মাত্র কয়েকজন ছেলের চাকরি ছাড়া আর কিছুই তারা দেয়নি। আমরা জানতে চাই, এই বিস্ফোরণের ফলে যে ক্ষতি হল তা আপনারা সরকারের ওপরের মহলে জানাননি? ওরা জানায়, কোম্পানির লোকরা ওদের লোকেদের দিয়ে সমীক্ষা করিয়ে ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ধার্য করে। এর কোনো নিয়ম নেই। গ্রামের প্রত্যেকের ঘর ভাঙার জন্য কেউ দু-হাজার, কেউ চারহাজার, কেউ পাঁচহাজার, কেউ সাতহাজার টাকা করে পেয়েছে। তাদের মতে এই টাকা কেবলই মুখ বন্ধ রাখার জন্য। ছ-মাস আগে এই নিয়ে চেক বিলি হয়েছে। এসডিএম জানায় এই সব কিছু তো হচ্ছে আপনাদের ভালোর জন্য।

গ্রামে সমীক্ষা করার পর সরকারের তরফে কোম্পানির লোকেদের নিয়ে প্রকল্পের আগে একটা জনশুনানি হয় ঠিকই কিন্তু সেটা গ্রামবাসীদের ভয় দেখানোর জন্য। বিশাল মাত্রায় আগ্নেয়াস্ত্রসহ পুলিশ আসে গ্রামে। এত পুলিশ দেখে গ্রামের অনেকেই ভয় পেয়ে আর কিছু বলতে পারে না। কেউ কেউ বিরোধিতা করলেও রাকেশ রাই নামে কোম্পানির একজন কর্মচারী পিস্তল দেখিয়ে গুলি করার হুমকি দেয়। কখনো কখনো কোম্পানির তরফে অযথা পুলিশি হেনস্থা আর গ্রেপ্তারের ভয়ও দেখায়। মাখান্ডার গ্রামবাসীরা জানায় কোম্পানি আমাদেরকে বিপদের মুখে ফেলে দিয়ে এখন চলে গেছে। সারা গ্রামের মধ্য দিয়ে টানেলের সুড়ঙ্গ চলে গেছে, এখন ওটা ফাঁকা, এই বর্ষায় ভূমিক্ষয়ে যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে, আমরা সকলেই আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছি।

ফেরার পথে গাড়িতে কথায় কথায় বারাসু গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষকের কথা শুনে বুঝলাম, এখানকার সকলেই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সাথে বানানো বড়ো বড়ো বাঁধের বিপদ বা ডিনামাইট ব্যবহারের ক্ষতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কিন্তু সবকিছু নিয়েই চলে রাজনীতি। হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছে উত্তরাখণ্ডের সাধারণ মানুষ এই সবকিছুই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। তবে শিব সিং জানিয়েছিলেন, একজন সিপিএম নেতা এসে গ্রামে এই বাঁধ বানানোর বিরুদ্ধে বলেছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর কথা কেউ শোনেনি। আজ তিনি সে কথা মনে করে আফশোস করছেন।