- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

উত্তরবঙ্গে বন্যপ্রাণ আর মানুষের দ্বন্দ্বের রোজনামচা

আধুনিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সরাসরি সংঘাত। প্রকৃতির সাথে সাথে পশুদের বাসস্থানও হারিয়ে যাচ্ছে। বন্য পশু প্রতিদিন চেষ্টা করছে হারিয়ে যাওয়ার আগে উন্নয়নের সাথে যুঝতে। মানুষ তার উন্নয়নের জন্য পশুদের বাসস্থান-গেরস্থালীর জায়গা প্রথমে ছোটো, তারপর সংকীর্ণ করে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। এখন বনের পশুরা কীভাবে তাদের প্রাকৃতিক কর্মাদি করে, তা দেখার জন্য জিপসি গাড়ি নিয়ে তাড়া করছে। পশুদের শোবার ঘরে অহোরাত্র ট্রাক, বাস, বাইক চালিয়ে পর্যটন ব্যবসা-উন্নয়ন বাড়িয়ে নিচ্ছে। দিশেহারা উদভ্রান্ত পশুরা একটু খাদ্যের বা বাসস্থানের জন্য মানুষের খপ্পড়ে পড়ছে নিত্যদিন। উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলে এই রোজনামচা আমরা এই সংখ্যায় প্রকাশ করছি, গত পনেরো দিনের ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’ দৈনিক পত্রিকার খবরগুলি সংকলন করে। পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলও নিশ্চয় ব্যতিক্রম নয়। আমরা আশা রাখছি, অন্যান্য অঞ্চল থেকেও এই ধরনের সংবাদ ভবিষ্যতে প্রকাশ করতে পারব। এই সংখ্যার সঙ্কলক রামজীবন ভৌমিক, ৩০ জুন#

 

ছবিটি রামজীবন ভৌমিকের তোলা।
ছবিটি রামজীবন ভৌমিকের তোলা।

১৪ জুন জলপাইগুড়ির মাল ব্লকের রাঙামাটি জিপির নিদাম চা বাগানে খাঁচা পেতে ছাগলের টোপ দিয়ে একটি স্ত্রী চিতাবাঘকে খাঁচাবন্দী করেছে চা-বাগান কর্তৃপক্ষ, এবং ভবিষ্যতে আরো কয়েকটি চিতা ধরা হবে বলে জানিয়েছে। ১৫ জুন সন্ধ্যেরাতে অধুনা আলিপুরদুয়ার জেলার শামুকতলা থানার ডাঙ্গি বাজার সংলগ্ন এলাকায় তিনটি ঘর (মানিক শীল, বিপুল বৈশ্য, চিন্ময় দাস) ভেঙেছে একটি দাঁতাল হাতি, তারপর গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়ে ছিপড়ার জঙ্গলের দিকে পালিয়েছে। ১৮ জুন আলিপুরদুয়ার ২ ব্লকের পুঁটিমারি গ্রামের বাবুপাড়া এলাকায় প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুটের একটি অজগর সাপ উদ্ধার করে বন দপ্তরের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বীরপাড়া ১ গ্রাম পঞ্চায়েত নিউলাইন এলাকায় শ্রীলঙ্কা বস্তিতে তিনটি হাতি ঢুকে ভুট্টা খেতে খাবার খেয়েছে। চাষি বনদপ্তরের ক্ষতিপূরণ পেয়েছে ২০ জুন।
১৮ জুন গরুমারা জঙ্গল থেকে একটি দাঁতাল হাতি বেরিয়ে মেটলি ব্লকের দক্ষিণ ধূপঝোরার হলদিয়া পাড়ার কোহিনূর হকের বাড়িতে ঢুকে বীজ ধান, রান্নার জিনিস নষ্ট করে। ওইদিনই চিলাপাতার পাতলা খাওয়া জিপির নেপালি বস্তিতে এক মাকনা হাতি ঢুকে তিনটি ঘর ভাঙে। বনদপ্তর ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে। গয়েরকাটা-বানারহাট সড়কের ধারে হীরা সাউ নামে এক ব্যক্তি দুটি বাচ্চা সহ একটি বিশাল হাতির সামনে পড়ে ও মারা যায়। বানারহাট চা-বাগান সংলগ্ন একটি মিষ্টির দোকানের ক্যাশবাক্সের ওপর হঠাৎ দেখা যায় বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বিষধর একট গ্রিন পিট ভাইপার বা সবুজ  বোরা সাপ। ২১ জুন কোচবিহারের পুণ্ডিবাড়ি আঙারাকাটা রেলগেটে ডাউন সরাইঘাট এক্সপ্রেসে ধাক্কা খায় একটি বিরল প্রজাতির প্যাঁচা।
২৩ জুন লাটাগুড়ির পূর্ত দপ্তরের বাংলো থেকে একটি বিশাল কিং কোবরা সাপ উদ্ধার করেন ময়নাগুড়ি রোড পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের সম্পাদক নন্দু রায়। ১৫ জুন আলিপুরদুয়ার বীরপাড়া লঙ্কাপাড়া চা বাগানের পাঁচ নম্বর লাইন ও বিশ নম্বর লাইনের পাশের তিতি জঙ্গল থেকে ১০টি হাতি এসে লঙ্কাপাড়া চা বাগানের শ্রমিক মহল্লায় ঢুকে পড়ে। রান্নাঘরের জানলা ভেঙে মজুত ভুট্টা চাল খেয়ে নেয় ও সুপারি গাছ ভাঙে। আলিপুরদুয়ার ১ ব্লকের পূর্ব কাঁঠালবাড়ি জিপির গাড়ারজোত, সিরুবাড়ি, সুরিপাড়া এলাকাটি বরাবর হাতির করিডর। ২০-২২টি হাতির পাল এই করিডর ব্যবহার করার সময় গাড়ারজোত এলাকায় কয়েকদিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কলাবাগান ও ঘরে মজুত চাল গম খেয়ে ফেলছে।
২৬ জুন ডায়নার জঙ্গল থেকে সুখানি নদী পেরিয়ে নাগরাকাটা সুলকাপাড়া জিপির ছাড়টন্ডুতে হাতি ঢুকে পড়ে। বধুয়া ওরাওঁ হাতি ঢুকেছে বুঝে ঘর থেকে পালিয়ে গেলেও নাবালিকা কন্যাকে নিয়ে ওনার স্ত্রী পাবাই ওরাওঁ (৩৬) হাতির সামনে পড়ে। নাবালিকাকে ছেড়ে দিলেও পাবাই-কে হাতি আছড়ে মেরে ফেলেছে। বন দপ্তর বিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। ২৬ জুন ২৫টি হাতির দল শীলতোর্ষা নদী পাড়ে চিলাপাতার জঙ্গল পেরিয়ে পাতলা খাওয়া গ্রামে ঢুকে পড়ে সকালবেলা পাট খেতে আশ্রয় নেয়। বনবিভাগের কর্মীরা এসে হাতিগুলিকে জঙ্গলে ফেরায়। লোকালয়ে চিতাবাঘের ভয়ে ২৭ জুন ছুটি দিয়ে দেওয়া হয় ধূপগুড়ির খলাই গ্রাম-২ প্রাথমিক বিদ্যালয়। \par
ফালাকাটা জিপির রাইচেঙ্গা আসাম মোড়ে তিনদিনের হস্তিশাবককে ফেলে জলদাপাড়া অভয়ারণ্যে ফিরে গেছে ৬০-৭০টি হাতির দল। মানুষের হাতের গন্ধ লাগলে হস্তিশাবককে আর দলে ফিরিয়ে নেবে না, এই ভয়ে শাবকটিকে হাতির মল মাখিয়ে তিনটি কুনকি হাতি দিয়ে দলের কাছে পাঠায় বন দপ্তর, ২৭ জুন। শাবক মাকে দেখে চিৎকার করে ছুটে যায়, মা-ও শাবককে দেখে ছুটে আসে। কিন্তু পরদিন সকালে গিয়ে বন দপ্তরের কর্মীরা দেখেন, মাত্র চারদিনের হস্তি শাবকটিকে ফিরিয়ে নিচ্ছে না দল। যেখানে ছাড়া হয়েছিল, তার চার কিলোমিটার দূরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাটি। মা কাছে কোথাও নেই। দূর থেকে গোষ্ঠীপতি দাঁতাল হাতি চোখ রাঙাচ্ছে। ফলে আবার হলং সেন্ট্রাল পিলখানায় শাবকটিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু মাত্র চার-পাঁচদিনের বাচ্চা হাতিকে মায়ের দুধ ছাড়া বাঁচানো কঠিন।