- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘আমি কেন কষ্ট করে এখানে কে কে দাঁড়িয়েছে তা জানতে যাব’

বঙ্কিম, কল্যাণগড়, ১৫ মে#

পিটিআই-এর ছবি
রাজনৈতিক হিংসার ছবি পিটিআই-এর তোলা


ভোটের কয়েকদিন আগে থেকে ভোটের কথা উঠতেই জিজ্ঞাসা করতাম, এবার কারা ভোটে দাঁড়িয়েছে? সাথে সাথেই প্রশ্ন, কেন তুমি জান না? ন্যাকামি করো না। কেউ বা সোজাসাপটা বলত বড়ো বড়ো কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের নাম। তাদের কথা শেষ হতেই জিজ্ঞেস করতাম, আর কেউ দাঁড়ায়নি? স্পষ্ট উত্তর, আর কে দাঁড়িয়েছে তাতে কী? মানুষ তো এদেরই ভোট দেবে। তোমার পছন্দ না হয়, তো ‘নোটা’ টিপবে। এত কথার কী? ‘ওপরের কাউকে পছন্দ করি না’ বলতে গেলেও তো জানতে হবে, কাদের পছন্দ করি না?
বন্ধুবান্ধবদের প্রায় সকলেরই হাতের মুঠোয় ইন্টারনেট। তবুও তাদের মধ্যে তেমন করে দেখার আগ্রহ নেই সত্যি সত্যি কতজন তার কেন্দ্রে ভোটে দাঁড়িয়েছে। ভোটের ঠিক আগের দিন সৈকত ফোন করে বলল, ও একটা ফাঁকা মাঠে বসে আছে। সেই ছাত্রজীবন থেকে একটা বামপন্থী দল করত সৈকত। রাস্তায় রাস্তায় মিটিংয়ে মিছিলে ভোটের প্রচার করেছে, বক্তৃতা দিয়েছে বিস্তর। এখন হঠাৎ সেখান থেকে স্বেচ্ছা অবসর নিয়ে নিয়েছে। এবারের ভোটে চুপচাপ। ও ‘নোটা’র কথা বলতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি জানো এখানে কারা দাঁড়িয়েছে? ওরও সেই একই উত্তর, এখানে জানার কী দরকার? আমি তো একরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছি। তবুও কিছু কথাবার্তার পর ও মোবাইলে বিভিন্ন সাইটে ঘোরাঘুরি করে প্রার্থীদের নামের তালিকা বার করে বেশ একটা হাসিমুখে ফেসবুকে তাদের সম্বন্ধে জানার চেষ্টা করল।
এর মাঝেই টিভি চ্যানেলের বন্ধু অভিজিত ফোন করেছিল। ও অনেকদিন পর এবার শহর থেকে গ্রামে ভোট দিতে আসছে। ও নোটা-র কথা বলল। কিন্তু ওর   কাছে যেই জানতে চাইলাম প্রার্থীদের সম্বন্ধে, ওর সোজা সাপটা কথা, আমি কেন কষ্ট করে সময় দিয়ে প্রার্থীদের জানতে যাব। যারা দাঁড়িয়েছে, তাদের দায়িত্ব আমাকে জানানো। তারাই জানাবে।
অপর এক বন্ধু ঘনা বেশ নাছোড়বান্দা। পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যেই আরটিআই করে। ও আরেক পা এগিয়ে নির্বাচন কমিশনের নাম্বারে ফোন করে তাদের কাছ থেকে ওয়েবসাইট জেনে নিয়ে প্রার্থীদের সম্বন্ধে অনেক কিছু (এভিটেবিট) জেনে নিয়েছে। শেষ মুহূর্তে আমাকে সেসব কথা শোনালো।

বারাসাত লোকসভা কেন্দ্রে কল্যাণগড় এলাকার ভোট বরাবরই বেশ শান্তিপূর্ণ। একসময়ের উদ্বাস্তু মানুষের সন্তান-সন্ততিরা অনেকেই অনেককে এখনও চেনে জানে। তারা বিভিন্ন মতে ভাগ হয়ে আছে দলে দলে — কোন্দলে। ভোটের দিন মফস্বল শহরের এসব ভোটকেন্দ্র ছাড়িয়ে লাগোয়া গ্রামের দিকে সাইকেলে এগিয়ে চলেছি। লোকজন বেশ আত্মবিশ্বাসের সাথে সকাল থেকেই ভোটের লাইনে দাঁড়িয়েছে। ভোট দিচ্ছে। গ্রামের অনেকেই পরস্পর বলাবলি করছে, এবার একটা ভোট, কোনো ঝামেলা নেই। কী তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। গত পঞ্চায়েত ভোটে রাত আটটা পর্যন্ত ভোট দিয়েছিল। রাস্তায় একজন নিজে থেকেই আমায় বলল, সেই সকাল থেকে লাইন দিয়ে ভোট দিতে ন-টা বেজে গেল। এবার কাজে বেরোব। বুঝলেন, কাল সন্ধ্যেবেলা ওরা আমার বাড়ি ভোট চাইতে এসেছিল। আমি বলেছি, ভোট দিয়ে জিতকে দিলাম। আর চুদির ভাই আমারে চেন না? সব সুবিধা নিজের লোকদের দিচ্ছ। আমার ঘর পড়ে যাচ্ছে। সেদিক নজর নাই। নিজের লোকদের ঘর দিচ্ছ। তোর মতো বেইমান নেই, যা তোরে ভোট দেব না … ক্ষোভের কথা বলতে বলতে সাইকেল নিয়ে চলে গেলেন।

গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। মাঠে মাঠে বোরো ধান কাটার মজুর না পাওয়ায় অনেকেই ফসল ঘরে তুলতে পারছে না। কাঠফাটা রোদে মাথা নিচু করে জনাসাতেক মানুষ আড়াই তিন বিঘা জমির ধান কেটে যাচ্ছে। খেতের ধারে ছাতা মাথায় দিয়েও দাঁড়াতে পারছি না। একটু বেলা হয়ে গেছে তবুও ওদের কাটতেই হবে ধান। কন্ট্রাক্টের কাজ তো। এখন বিঘা প্রতি আড়াই হাজার টাকা। ধান কাটা বাঁধা ঝাড়া বিচুলি গাদা করে দেওয়া, কখনও বা ঘরে ধান তুলে দেওয়া। পাঁচ সাত জন মিলে কাজ করে, একটা দিন কাটা, একদিন বাঁধা, ঝাড়া তোলায় আরেকদিন চলে যায়। একসাথে অনেকটা করতে পারলে তবু কিছু টাকা হয়। কিন্তু আজকাল রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করলেও এরচেয়ে কম খাটনিতে আড়াইশো তিনশো টাকা দিনে রোজগার হয়। এইসব কথাই বলছিলেন একজন মালিক, তাঁরও খেতে ধান রয়ে গেছে। কাজের চাপে কোমর সিধা করার উপায় নেই। একজন বয়স্ক লোকও কাজ করছে। তবু উনি কোমর সিধা করে বললেন, ও বিকেলের দিকে ভোট দেব খনে।
অপর দিকে শহর থেকে পার্টির দাদারা মোটরবাইকে গ্রামে গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে বেশ শলা পরামর্শ করছে। কোনো কোনো দাদা গ্রামের রাস্তার ধুলো উড়িয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বেশ কয়জন শহুরে ধোপদুরস্ত ভদ্রলোক একই রকমের পাঞ্জাবি পরে গাড়ি থেকে নামলেন। গ্রামে তাঁদের দলীয় কর্মীদের উৎসাহিত করছেন আর ভোট দেখছেন।
গাছতলায় একটি কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার যুবকের সাথে কথা হচ্ছিল। পুকুর থেকে স্নান করে ঘরে ফেরার পথে তাঁর প্রতিবেশী যুবকটির উদ্দেশ্যে বললেন, ভোটটা জায়গামতো দিয়েছিস তো। যুবকটি মৃদু হেসে বলল, জায়গামতো মানে বুঝলেন তো? ওঁর পার্টিতে। ও বলল, ওর বন্ধু বলছিল, ভোট দিতে যাবি, দেখবি একটা মেশিন, কতগুলি বোতাম, পাশে ছবি, বোতাম টিপবি, শব্দ হবে, আলো জ্বলবে। একটা মেশিন কী বানিয়েছে দেখ। তাই নিয়ে ভাব। অত দেশটেশ ভাবার কী আছে।
দুপুরের রোদে ভোটারদের সংখ্যা কমে গেছে। গ্রামের একটা গাছতলায় রাজনৈতিক দলের বেশ কিছু কর্মী গুলতানি মারছে। এক বিজেপি সমর্থক তার পূর্বতন সিপিএম বন্ধুর সঙ্গে গপ্পো মারছে — এবার ভোটে তোরা বেশ টাকা পেয়েছিস বল। বেশ বড়ো বড়ো ক্যাম্প করেছিস। সে হেসে বলল, দ্যাখ। আমি তৃণমূলের সমর্থকদের ডেকে বলছি, একটা ভোট দাও না। সাথে সিপিএম বন্ধুটি হেসে বলল, আমিও জানিস তো ওদের বলছি, তোমরা বিজেপি-কেই ভোট দাও। এরপর দু-জন হাসল।
এই গরমে একজন কর্মী এক বৃদ্ধাকে সাইকেলের কেরিয়ারে বসিয়ে বুথে নিয়ে এল। বৃদ্ধাকে যত্ন করে ধরে সাইকেল থেকে নেমে দাঁড় করালো। বলল, ঠাকুমা, ঠিকমতো ভোট দেবে কিন্তু। তিন নম্বরে। পাশ থেকে আরেকজন বলল, ঠাকুমা কি তিননম্বর কী বোঝে। ঠাকুমা সিংহ চিহ্ন টিপবে কিন্তু (ঠাকুমা সিংহ চিহ্ন না তার পাশের বোতাম টিপেছিল — কি জানি)। ঠাকুমা কোনো কথাই বলল না। লাঠি ভর দিয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইল কেবল।
কেন্দ্রীয় বাহিনীতে কাজ করে আমার বন্ধু। এখন দেশের বিভিন্ন রাজ্যে নির্বাচনের ডিউটি করছে। সদ্য গুজরাটে নির্বাচন করিয়ে এখন পশ্চিমবঙ্গে ডিউটিতে এসেছে। ও বলছিল, নির্বাচনে যে কী টাকা খরচ হয় ভাবতে পারবেন না। তবু দেখুন, আমার দু-বারের নির্বাচনের ডিউটির টাকা এখনও পাইনি। এখানে শুনছি কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইছে। আমরা কী করব বলুন। পুলিশেরও তো অস্ত্র আছে। কিন্তু পাওয়ার না দিলে কী হবে? এদিকে সৎও নয়, আর সচেতনও নয়। আবার বাহিনীকে কাজ করতেও দেবে না। তবে মানুষ মরবে। আর মরছেই তো।
শুনুন, গুজরাটে ইলেকশন ডিউটিতে গেছি এক গণ্ডগ্রামে। সেখানকার অবস্থা কল্পনাও করতে পারবেন না। ওরা ওদের ভাষা ছাড়া কিছু বলেও না, বোধহয় বোঝেও না। আর আমরা ওদের কথা কিছুই বুঝি না। ভোট শুরু হল, ভোটার কোন বোতাম টিপবে, সেখানে পার্টির লোক পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। ভোট বিজেপিতেই পড়ছিল। আমাদের মেজর সাব বললেন, এভাবে ভোট হলে ভোট বাতিল হলে আবার ইলেকশন হবে। সেখানকার মুখিয়া, পার্টি নেতা, বললেন যা তার মানে দাঁড়ায়, আমাদের বন্দুক দেখাচ্ছ? আমাদেরও বন্দুক আছে। নির্বাচন কর্মীরা বলল, সত্যি সত্যিই ওখানে মানুষের ঘরে ঘরে বন্দুক আছে। ওদের শখ বন্দুক রাখা। সে লাইসেন্স থাক বা না থাক। এর পর প্রিসাইডিং অফিসার ওদেরকে বুঝিয়ে বললেন, তোমরা যদি এমন করো তাহলে ভোট বাতিল হয়ে গিয়ে পরে অনেক বাহিনী এসে এখানে ভোট হবে। এরপর ওরা কিছুটা শান্ত হল, মোটামুটি নির্বাচন হল। নির্বাচন কর্মীরা বলল, দেখবেন, আপনাদের বন্দুক সাবধানে রাখবেন। এরা কিন্তু সুযোগ পেলেই বন্দুক চুরি করে পালাবে। পরে ওদের গাঁয়ের একটি ছেলে যে মোটামুটি একটু কথাবার্তা বলতে পারে, সে দেখলাম, বন্দুক নিয়ে খুব আগ্রহ দেখাচ্ছে। আমাদের বন্দুকের ক্ষমতা শুনে জিজ্ঞাসা করল, এই বন্দুক কোথায় কিনতে পাওয়া যায়। আমি বললাম, সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে তুমিও এমন বন্দুক পাবে। সে আপশোশ করে বলল, পাঁচ সাতবার ইস্কুল ফাইনাল দিয়েও সে পাশ করতে পারেনি।