- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

‘আমাদের দেশেও জলবায়ু পরিবর্তন একটি ঘোরতর বাস্তব’

সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, কলকাতা, ৪ ডিসেম্বর#

লাদাখের 'শীতল মরুভূমি'তে ২০১০ সালের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী। ছবি তিব্বতী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে।
লাদাখের ‘শীতল মরুভূমি’তে ২০১০ সালের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী। ছবি তিব্বতী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট থেকে।

— আমি ছোটোবেলা লাদাখে কাটিয়েছি। লাদাখ অঞ্চলটি শীতল মরুভূমি বলে পরিচিত। ২০১০ সালের আগস্ট মাসে সেখানে ভয়াবহ হড়কা বান ও বিপর্যয়ের পর সরকার গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এত বেশি উচ্চতায় গাছ লাগানো হচ্ছে, এতে কি লাভ হচ্ছে না ক্ষতি হচ্ছে?
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন এক কলেজ পড়ুয়া। উপস্থিত বিজ্ঞানীরা জবাব দিতে গিয়ে বললেন, গাছ লাগালে সংলগ্ন বাতাস পরিষ্কার থাকে, ধূলিকণার পরিমাণ কমে যায়। ফলে জলীয় বাষ্প সেখানে ধরা পড়ে যাওয়ার প্রবণতাও কমে যায়। তার ফলে হঠাৎ বৃষ্টিপাত ও হড়কা বানের সম্ভাবনা কমে যায়। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচু এলাকায় বৃক্ষরোপণ সেখানকার জলবায়ুজনিত বিপর্যয় কিছুটা রোধ করতে সক্ষম। এই প্রশ্নের উত্তর শোনার সময় আরও জানা গেল, বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকতে পারে মাত্র নয় দিন। কার্বন ডাই অক্সাইড থাকে তিন বছর।

লিমায় বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনও ব্যর্থ
ডিসেম্বর-এর প্রথম অর্ধে পেরু-র লিমা শহরে সারা বিশ্বের রাষ্ট্রনেতারা বসেছিল রাষ্ট্রপুঞ্জের আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলনে। ঘোষিত লক্ষ্য ছিল সব দেশ মিলে একটা প্রস্তাব নেওয়া কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে, যাতে বিশ্ব তাপমাত্রা বর্তমানের তুলনায় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের চেয়ে বেশি না বাড়তে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রস্তাব এনেছিল, সমস্ত দেশ আইন করুক, যে তারা ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৪০ শতাংশ কমাবে, ১৯৯০ সালকে ভিত্তিরেখা ধরে। কিন্তু কোনো বিষয়েই খুব একটা এগোতে পারেনি দেশগুলির বোঝাপড়া।

 

এক স্কুল ছাত্রী প্রশ্ন করলেন, রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চলে পর পর গাছ লাগিয়ে তাকে সুজলা সুফলা করে তোলা হচ্ছে। তাতে কি আখেরে লাভ হবে না ক্ষতি হবে? একজন প্রশ্ন করলেন, তাপমাত্রা যে বাড়ছে, তার কারণ কি শুধু সূর্যের তাপ, ভূগর্ভস্থ তাপের কি কোনো ভূমিকা নেই? উত্তরে বিজ্ঞানীরা জানালেন, সূর্য বা মহাকাশের তাপের ভূমিকার তুলনায় ভূগর্ভস্থ তাপের ভূমিকা পাঁচ হাজার ভাগের এক ভাগ, অর্থাৎ নগণ্য। এভাবেই প্রশ্ন উত্তরের মধ্যে দিয়ে জমে উঠেছিল জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সিম্পোসিয়াম, কলকাতার আইআইসিবি-র প্রেক্ষাগৃহে ৪ ডিসেম্বর।
প্রশ্নোত্তর পর্বের আগে একের পর এক বক্তব্য রাখলেন বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা। সবচেয়ে নাটকীয়ভাবে জলবায়ু পরিবর্তনটি ব্যাখ্যা করলেন অবসরপ্রাপ্ত ভূতত্ত্বের শিক্ষক রাজামণি। তিনি বিভিন্ন বিজ্ঞান পত্রিকায় বেরোনো প্রবন্ধের তথ্য তুলে দেখালেন, ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে ভারতবর্ষের গড় তাপমাত্রা দ্রুতহারে বেড়ে চলেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শিল্পবিপ্লবের সময় থেকেই গোটা পৃথিবীর তাপমাত্রা দ্রুতহারে বাড়ছে।
বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ আইস এজ-এ ১৮০ পার্টস পার মিলিয়ন থেকে গ্লেসিয়াল এজ-এ ২৮০ পার্টস পার মিলিয়ন হয়েছে। কিন্তু এখন এর পরিমাণ ৪০০ পার্টস পার মিলিয়ন। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে — ১৯৯৩-২০০২ সালের পরিসংখ্যানে অন্তত ১০ পার্টস পার মিলিয়ন বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।
আর বাড়ছে তাপ প্রবাহের সময় ও মাত্রা। এর বৃদ্ধিও হচ্ছে ১৯৭০ সালের মাঝের সময় থেকে। একই কথা সমুদ্র তলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভারতের লাগোয়া সমুদ্রতল বছরে তিন মিলিমিটার করে বাড়ছে।
১৯০১ থেকে ২০১১ সালের বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাচ্ছে, ১৯৬৫ সাল থেকে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা হলেও কমেছে। মূলত কমেছে মধ্য ভারতের রাজ্যগুলোতে, ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড প্রভৃতি জায়গায়। ভারতের বৃষ্টিপাতকে যদি তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে মাঝারি ও বেশি মাপের বৃষ্টিপাত কমেছে। কিন্তু অতি বেশি মাপের অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে।
বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোনের পরিমাণ কমেছে। নিম্নচাপের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু মারাত্মক আকারের সাইক্লোনের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮৪০ থেকে ২০০০ সালের পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাচ্ছে, বন্যার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অতিকায় বন্যার সংখ্যা বেড়েছে।
উপগ্রহ চিত্র থেকে দেখা যায়, হিমালয়ের পশ্চিম দিকের হিমবাহ বাড়ছে, পূর্ব হিমালয়ে হিমবাহ কমে যাচ্ছে। কিন্তু যদি হিমবাহের ভরের হিসেব করা যায়, তাহলে ২০১২ সাল পর্যন্ত হিসেবে দেখা যাচ্ছে প্রতি বছর হিমবাহ ভর ৬.৬ গিগাটন করে কমছে। অর্থাৎ হিমালয়ের হিমবাহের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।
চাষের মাঠের দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে, গমের উৎপাদন কমে চলেছে।
গত ১১০ বছরের এই সমস্ত পরিসংখ্যানই ইঙ্গিত দেয় — আমাদের দেশ ভারতবর্ষেও জলবায়ু পরিবর্তন একটি বাস্তব ঘটনা। এর ফল ভুগছে মানুষ সহ গোটা জীবজগৎ, কিন্তু এর জন্য দায়ী কেবল আমরা মানুষরাই — পরিষ্কার বলে দিলেন বিজ্ঞানী রাজামণি।
কলকাতার বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের কয়েকশো ছাত্রছাত্রীর উপস্থিতিতে প্রেক্ষাগৃহে তিল ধারণের জায়গা ছিল না।