- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

আনন্দবাজারে প্রকাশিত ‘জঙ্গলমহলের নয়া মাওবাদী নেতা’ সংক্রান্ত খবরের প্রতিবাদ

সুমিত সরকারের চিঠিটি ইংরেজিতে ফেসবুক-এ পাওয়া। বাংলা অনুবাদ শমীক সরকার, ৩০ জুলাই#

sumit
গভীর উদ্বেগের সঙ্গে এই চিঠি লিখছি। আপনাদের সংবাদের মানের এই অবনমন মেনে নেওয়া যায় না। ২৫ জুলাই আপনাদের কাগজে সুরবেক বিশ্বাসের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় জঙ্গলমহলে মাওবাদী প্রভাবের বিষয়ে। সেখানে বলা হয়, ‘বারাকপুরের সুমিত সরকার’ মাওবাদীদের একজন সাম্ভাব্য নেতা।
এটা সত্যি যে পিপলস ওয়র গ্রুপ আন্দোলনের কারণে আমার ওপর বিভিন্ন মামলা আছে। বহুদিন ধরেই আমি দাবি করছি যে এইসব মামলাগুলিই মিথ্যে এবং সাজানো। পুলিশের কিছু কিছু অফিসিয়াল পরিষ্কারভাবে আমাকে প্রস্তাব দিয়েছিল, যদি আমি সরকারের চর হিসেবে কাজ করি, তাহলে তারা আমাকে বিরক্ত করবে না। কিন্তু আমি মনে করি এই প্রস্তাবে সহমত হওয়া অনৈতিক কাজ। মাওবাদীদের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু আমি মনে করিনা যে রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক বিতর্ক ছাড়া সমাধান হতে পারে। আমি দু-বার গ্রেপ্তার হয়েছি, কয়েক মাসের মধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়েছি। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও পুলিশ বিভাগের বিচার-বহির্ভুত কার্যকলাপের কারণে আমাকে প্রচুর ভুগতে হয়েছে।
এই ভাবে বারবার আমাকে শূণ্য থেকে শুরু করতে হয়েছে আমার পরিবার সামলাতে, নিজের জোরে এবং স্ত্রী জ্যোৎস্না মাহাতোর সহায়তায়। এখন আমি দুই সন্তানের পিতা।
২০০৬ সাল থেকে আমি প্রায় নিরুপদ্রবে আমার জীবন কাটিয়েছি আমার নিজের রাস্তায়। এই সময়ে আমি আমার রাজনৈতিক মতামত তৈরি করেছি — দক্ষিণপন্থী, বামপন্থী বা কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক দলগুলির স্লোগান যাই থাকুক না কেন, তারা প্রকাশ্যে বা গোপনে অস্ত্র ব্যবহার করুক না কেন, তারা বিপ্লবী বা প্রতিবিপ্লবী যাই হোক না কেন, প্রত্যেকেই সাধারণ মানুষের শত্রু। সাধারণ মানুষের পরিষেবা ব্যবহার করে ক্ষমতাশালী কয়েকজন, অথবা তারা সাধারণ মানুষের প্রায় কোনো কাজে আসে না।
আমি মনে করিনা সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক দল বা রাষ্ট্রের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আছে। রাজনৈতিক দল এবং রাষ্ট্র একই পীড়নযন্ত্রের দুটো দিক। যখনই এবং যেখানেই তারা শক্তিশালী, সেখানেই লোকে তা হাড়েহাড়ে টের পায়।
আমি বিশ্বাস করি একমাত্র সমাজেই প্রকৃত গণতন্ত্র সম্ভবত চলতে পারে। তাই আমার গান্ধী বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনাগুলোর মতোই প্রায় গ্রাম স্বরাজ/পল্লী সমাজকে শক্তিশালী করায় নজর।
ওড়িশার ময়ুরভঞ্জে আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে থাকার মধ্যে দিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি, এই আদিবাসী জীবনধারা থেকেই সত্যিকারের গণতন্ত্রের নেওয়ার আছে। কারণ সেখানে আছে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ — কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ব্যাপার নেই। স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের মধ্যে ফারাক খুব সামান্যই থাকে যেখানে কোনো সিদ্ধান্ত নিরূপণে সংখ্যালঘুর মতামত কোনো গুরুত্ব পায় না। যদিও আমি মনে করি আদিবাসী সমাজেরও ব্যাপক আন্দোলন অবশ্য প্রয়োজনীয় তার পিতৃতন্ত্র থেকে মুক্ত হবার জন্য।
অন্য দিকে জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, জৈব বৈচিত্র্যের বড়ো আকারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, জঙ্গল ধ্বংস, তেল এবং জল খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং অনেকদিন ধরেই আমি জৈববৈচিত্র্য যুক্ত জৈব চাষ এবং কারুশিল্পের মাধ্যমে এগুলির সমাধানকল্পে কিছু কাজকর্ম করার সুযোগ খুঁজছিলাম।
এই ধারণার বাস্তবায়নের জন্য আমি আমার শ্বশুরবাড়ি চলে আসি (লালগড় থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে) বছর দুই আগে। এখানে একজন অন-লাইন অনুবাদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি আমি মূলতঃ জৈব চাষ করার ব্যাপারে মনোনিবেশ করেছি। এখনও অবধি আমি বিভিন্ন ধরনের চাষ করেছি কেবলমাত্র জৈব পদ্ধতিতে। ফলাফল খুবই আশাব্যাঞ্জক এবং তা নাগরিক সমাজকে এই দিকে তাকাতে সাহায্য করবে।
তাছাড়া, উৎপাদনশীলতা কমে আসা, ক্যানসারের ব্যাপকতা এবং চাষির আত্মহত্যার এটাই একমাত্র সাম্ভাব্য উত্তর। এর আরেকটা দিক হলো, আমাদের খাদ্য সুরক্ষাই সঙ্কটের মুখে কারণ আমাদের উপমহাদেশের চাষিরা এখনও বীজের জন্য ভিক্ষা করছে, চাষের অন্য সমস্ত উপকরণ আসছে কতিপয় কোম্পানির থেকে যাদের বেশিরভাগই বিদেশী বহুজাতিক। আমরা যদি আমাদের চাষের অভিমুখ বদল না করি, তাহলে আমাদের স্বাধীনতাও সঙ্কটে।
যদিও আমি মাওবাদীদের কারোর সঙ্গে সংস্পর্শ রাখিনা, আমি ধরে নিতে পারি মাওবাদী বা অন্য কোনো রাজনৈতিক পার্টি নেই, যারা আমি ওপরে যে সমস্যাগুলোর কথা বলেছি সেগুলোর সাম্ভাব্য উত্তর দিতে চায় বা অন্তত খুঁজতে চায়। তথাপি আমি অবাক হয়ে দেখছি, আমাকে মাওবাদী পার্টির লোক হিসেবে বলা হচ্ছে।
যদি এটা আপনাদের হাউস-এর কোনও রিপোর্টারের কল্পনা না হয়, তাহলে এটা কী? যদি আমি ধরে নিই যে সরকারি সূত্র থেকে আপনারা এই খবর পেয়েছেন, তবুও আপনাদের দোষ ঢাকা পড়ে না। কারণ আমি মনে করি রিপোর্টারদের রাবার স্ট্যাম্পের কাজ করা উচিত নয়। তাদের উচিত কোনো অভিযোগকে নিজেরা খতিয়ে দেখা, সেটি সঠিক কি না।
আর সত্যিই যদি সরকার আমাকে মাওবাদী নেতা মনে করে, তাহলে আমি কেবল তাদের করুণা করতে পারি।
ধন্যবাদ,
‘ব্যারাকপুরের’ সুমিত সরকার
৩০ জুলাই ২০১৫