- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

অর্থনীতির দাওয়াইকে ‘না’ জানিয়ে মানবতার বিশ্বায়নের পক্ষে দাঁড়ালো গ্রীসের জনতা

শমীক সরকার, কলকাতা, ৫ জুলাই#

৫ জুলাই ফল বেরোনোর পর সিনটাগমা স্কোয়ারে উৎসব। ছবি রয়টার।
৫ জুলাই ফল বেরোনোর পর সিনটাগমা স্কোয়ারে উৎসব। ছবি রয়টার।

‘ত্রৈকা’-র দেওয়া কৃচ্ছসাধনের দাওয়াই মানল না গ্রীসের জনতা। ৫ জুলাইএই নিয়ে গণভোটে প্রায় ৬২ শতাংশ মানুষ তাদের মতামত জানাল — ‘না’। গ্রীসের মোট ভোটারের ষাট শতাংশের কিছু বেশি মানুষ এই গণভোটে অংশ নিয়েছিল।
আইএমএফ-ইউরোপিয়ান কমিশন-ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক — এই ‘ত্রৈকা’ বা পাওনাদার ত্রিমূর্ত্তি গ্রীসের জন্য ফের একবার দাওয়াই দিয়েছিল — আরো কড়া কৃচ্ছসাধন। একের পর এক এই ধরনের দাওয়াই তারা দিয়েই চলেছে ২০১০ সাল থেকে, যখন ২০০৭-০৮ সালের আবিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া গ্রীস ঋণ চায় এই ত্রিমূর্ত্তির কাছে। কৃচ্ছসাধনের বিরুদ্ধে জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়েই এবছর জানুয়ারি মাসে সরকার গঠন করে নয়া বাম সিরিজা, সঙ্গে পায় দক্ষিণপন্থী আনেল-কে। তাদের কাছে ত্রিমূর্ত্তি যে প্রস্তাব দিয়েছিল, তা না মেনে তা নিয়ে ২৭ জুন হঠাৎ-ই গণভোট ডেকে দেয় সিরিজা। এবং গ্রীসবাসীকে এই প্রস্তাব না মানতে আহ্বান জানায়।
দেশের চিরাচরিত দুই বাম-ডান পার্টি — পাসোক এবং এনডি, তারা কৃচ্ছসাধনের প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ায় এবং গ্রীক সংসদে এই গণভোটের প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করে। দেশের সমস্ত মিডিয়া হাউস কৃচ্ছসাধনের প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ায়। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক নজিরবিহীনভাবে এই প্রস্তাবের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য গ্রীসবাসীকে আহ্বান করে। ইউরোপিয়ান কমিশন, জার্মানি-ফ্রান্স-ইতালি সহ ইউরোপের রাষ্ট্রপ্রধানরা সরাসরি জানিয়ে দেয় — এই গণভোটে যদি গ্রীস ‘না’ বলে, তবে তা হবে ইউরো, ইউরোজোন এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে গ্রীসের সরে আসা।
গণভোটের দু-দিন আগে ইসিবি জানিয়ে দেয়, গ্রীসের ব্যাঙ্কগুলোকে তারা ইউরো সরবরাহ করা বন্ধ রাখছে। ফলে গ্রীসের ব্যাঙ্কগুলো বন্ধ হয়ে যায়। অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে পড়ে গ্রীসের মানুষ।
গ্রীসের অর্থমন্ত্রী ইয়ানিস ভারুফাকিস স্পেনের একটি সংবাদমাধ্যম-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ইউরোপের রাষ্ট্রপ্রধানরা গ্রীসের জনগণকে ভয় দেখাচ্ছে যে গণভোটে যদি তারা ‘না’ এর পক্ষে ভোট দেয়, তাহলে তাদের চরম দুর্দশায় পড়তে হবে। ভয় দেখিয়ে কোনো কাজে বাধ্য করাকে বলে টেরোরিজম। ইউরোপ গ্রীসের সাথে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাচ্ছে। (http://www.elmundo.es/economia/2015/07/04/5596f1b3ca47412d048b459e.html)
গ্রীসের মিডিয়া হাউজগুলো ‘জনমত সমীক্ষা’ করে দেখাতে থাকে — ‘না’ এবং ‘হ্যাঁ’-এর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।
গ্রীসের বিভিন্ন শহরে তো বটেই, ইউরোপের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হতে থাকে — ‘গ্রীসের ঋণ বাতিল করো’। স্পেনের পোডেমস, ইতালির বেপ্পে গ্রিলোর পার্টি ফাইভ স্টার মুভমেন্ট ‘না’ এর পক্ষে অবস্থান নেয়। গ্রীসের কৃচ্ছসাধনবিরোধী জনআন্দোলনগুলি ‘না’ এর পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে শুরু করে। গ্রীসের কমিউনিস্ট পার্টি ভোটদানে বিরত থাকার আহ্বান জানায় মানুষকে — কারণ হিসেবে তারা বলে, এই ভোটে ‘না’-র বিজয় হলে তাকে সিরিজা দেখাবে তাদের বিকল্প প্রস্তাবের সমর্থন হিসেবে, যে বিকল্প প্রস্তাবটিও প্রায় একইরকম জনবিরোধী। গ্রীসের জনআন্দোলনগুলি কমিউনিস্ট পার্টি-র এই অবস্থানকে সংকীর্ণতাবাদী বলে সমালোচনা করে।
গণভোটের আগের দিন এথেন্সের ‘সিনটাগমা স্কোয়ার’-এ প্রায় হাজার কুড়ি মানুষের জমায়েত-এ গ্রীসের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি সিপারাস বলেন, গ্রীসের ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের দোহাই — ‘না’। (http://links.org.au/node/4494)

উল্লেখ্য, ১৮২১ সালে অটোমান সাম্রাজ্য থেকে গ্রীসের স্বাধীনতার ঘোষণা ইউরোপের সংরক্ষণবাদী জমানাকে টলিয়ে দিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ইউরোপের তিন মহাশক্তিধর দেশ জার্মানি-ইংলন্ড-ফ্রান্স গ্রীসের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও নিজেদের দেশে জনতার চাপে কয়েকবছরের মধ্যে গ্রীসের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছিল তারা।
অবশেষে ৫ জুলাই-এর গণভোটে প্রায় ৬২ শতাংশ গ্রীক ভোটদানকারী জানিয়ে দিল, তারা কৃচ্ছসাধনের বিপক্ষে। দেশের ঋণের দায় তাদের নয়, দেশের ধনী-ব্যবসায়ী-কর্পোরেট-এলিটদের নয়ছয়ের দায় তারা নেবে না, মার্কিন ‘হাউজিং বাবল’ জনিত আবিশ্ব অর্থনৈতিক সঙ্কটের দায় তারা নেবে না। তারা সম্মান নিয়ে ইউরোপে বাঁচতে চায়।

তথ্যসূত্র : টুইটারের #greekreferendum সূত্রে পাওয়া বিভিন্ন সংবাদরিপোর্ট, শ্রীমান চক্রবর্তী, উইকিপিডিয়ায় আধুনিক গ্রীসের ইতিহাস।