- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

অবাধে সাইকেল চালাতে চেয়ে কলকাতা জুড়ে সত্তর কিমি দীর্ঘ নজিরবিহীন সাইকেল-র‍্যালি

তমাল ভৌমিক, কলকাতা, ২৩ ফেব্রুয়ারি#

ছবি সোহিনী রায়ের তোলা, ২৩ ফেব্রুয়ারি
ছবি সোহিনী রায়ের তোলা, ২৩ ফেব্রুয়ারি

২৩ ফেব্রুয়ারির নির্ধারিত সাইকেল র‍্যালি তারাতলা থেকে শুরু হয় সকাল ৮টায়। থ্রি-এ বাসস্ট্যাণ্ড, ক্যাওড়াপুকুর, করুণাময়ী হয়ে টালিগঞ্জ মেট্রোয় পৌঁছাতে দেখা গেল জনাপঞ্চাশেক আরোহীর তিনজনের সাইকেল গণ্ডগোল। মেট্রোর সামনে গিয়ে দলের সঙ্গেই আসা সাইকেল-চিকিৎসক হারাধন বেরা মেরামতি করে দিলে আবার যাত্রা শুরু হল। বেশিরভাগ তরুণ-যুবক, একজন যুবতী ও পঞ্চাশোর্ধ পাঁচ সাতজন সাইকেল চালাচ্ছেন।
রকমারি সব ব্যানার আর পোস্টার ঝুলছে সাইকেল চালকের বুকে পিঠে, সাইকেলের হ্যান্ডেলে; সাইকেলের পিছন পিছন আসা জলের ড্রাম, সাইকেলের পাম্প ও মেরামতির জন্য আর বাংলা-হিন্দি-উর্দু-লিফলেট ঠাসা ব্যাগ বহনকারী ম্যাটাডোরের চারধার ঘিরেও ব্যানার। কলকাতা সাইকেল সমাজ সহ বিভিন্ন সংগঠনের ডাকে এই চক্রাকারে সাইকেল র‍্যালিতে যোগদানের আহ্বান জানানো হয়েছে ওইসব ব্যানার-পোস্টারে। সঙ্গে আছে কলকাতার সব রাস্তায় দিনে-রাতে সব সময় সাইকেল চালানোর অধিকার, চওড়া রাস্তায় সাইকেল লেন এবং সাইকেলজীবীদের নিরাপত্তা ও সম্মানের নানা দাবি। এক তরুণ সাইকেলকে চুমু জানিয়ে লিখেছে ‘তোমাকে চাই’, আরেকজন লিখেছে ‘ফুরিয়ে আসছে তেল, চালাও সাইকেল’।
মাঝে মাঝেই র‍্যালি থেকে শ্লোগান উঠছে, ‘হকারের সাইকেল, চলছে চলবে’, ‘বেকারের সাইকেল, চলছে চলবে’, ‘প্রেমিকের সাইকেল, চলছে চলবে’। আরও কত কী। রবিবারের রাস্তায় এমনিতেই ট্রাফিক কম। এছাড়া ট্রাফিক পুলিশও র‍্যালির সঙ্গে সহায়তা করছিল সাধ্যমতো।
দেখতে দেখতে সাইকেল মিছিল রানিকুঠি, গড়িয়া, বাঘাযতীন পার হয়ে যাদবপুর ৮বি বাসস্ট্যান্ড ঢুকে পড়ল। মাঝখানে যোগ দিয়েছে অনেকে, কেউ কেউ আবার র‍্যালি থেকে অব্যাহতি নিয়েছে। সেরকমই হওয়ার কথা ছিল, উদ্যোক্তাদের সেরকমই পরিকল্পনা ছিল। ৮বি বাসস্ট্যান্ডে সাইকেল গুনে প্রদীপ জানা জানালেন, সাইকেল রয়েছে ৯১টা। আরেক বন্ধু বলল, পুলিশ ফোনে খবরাখবর করছে, ১১০ জন সাইকেল চালাচ্ছে র‍্যালিতে।
৮বি বাসস্ট্যান্ডে কিছুটা দেরি হওয়ায় নির্ধারিত পথ কিছুটা কমাতে হল — সন্তোষপুর-অজয়নগর অঞ্চলদুটো বাদ দিতে হল। সেখানে যারা র‍্যালিতে যোগ দেবে বলে অপেক্ষা করছিল, তারা যাদবপুর, পালবাজারে ও সাঁপুইপাড়ায় এসে যোগ দিল।

যাদবপুর থানা হয়ে মিছিল চলল গড়িয়াহাট-পার্কসার্কাস-এন্টালি হয়ে মানিকতলা-কাঁকুড়গাছির দিকে আসছে। কখনও পুরুষ কণ্ঠে, কখন মহিলা কণ্ঠে শ্লোগান উঠছে — ‘সাইকেলের ওপর জুলুম-ফাইন আর নয়’, ‘নো সাইক্লিং বোর্ড নয়’, ‘সাইকেল চালান পরিবেশ বাঁচান’, ‘সাইকেল চালান পকেট বাঁচান’, ‘সাইকেল চালান স্বাস্থ্যবান হোন’ ইত্যাদি। উৎসাহী যুবকেরা কেউ কেউ গড়িয়াহাট ব্রিজের ওপর দিয়ে চালিয়ে গেল — এই ব্রিজ সাইকেল-চালকদের জন্য একেবারে নিষিদ্ধ। বয়স্করা কেউ কেউ তাই দেখে একটু হাসল। এন্টালির কাছে গিয়ে একটা সংক্ষিপ্ত পথসভাও হল। সবচেয়ে মজা হল শিয়ালদা ব্রিজের ওপর দিয়ে সাইকেল চালানোর সময়। এই ব্রিজটির ওপর দিয়ে সাইকেল চালানো এক্কেবারে নিষিদ্ধ!
কাঁকুরগাছিতে পৌঁছে র‍্যালিকে চা-জল খাইয়ে অভ্যর্থনা করল অভিযান ক্লাব। এখানে দুপুরে খাওয়ার সময়ে একটা বড়ো সমস্যা দেখা দিল। খাবারের ব্যবস্থার দায়িত্ব যাঁকে দেওয়া হয়েছিল, তিনি খাবার সরবরাহ করতে পারেননি। শেষে কাঁকুরগাছির হাউসিং কোয়াটারের সংলগ্ন ‘কাঁকুরগাছি অভিযান ক্লাব’-এর সদস্যরা এগিয়ে এসে সাইকেলযাত্রীদের সবজি-ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করে দিল। সাইকেল র‍্যালিতে অংশগ্রহণকারীরা নির্দ্ধিধায় সেই আধপেটা খাবার খেয়ে আবার রওয়ানা দিল পরবর্তী পথের উদ্দেশ্যে। অবশ্য মনে মনে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছে, টের পাওয়া যাচ্ছিল মুখচোখ দেখে। দুপুরে খাওয়ার পর উল্টোডাঙ্গা, শ্যামবাজার হয়ে কলেজ স্কোয়ারে পৌঁছানোর পথ আবার কিছুটা সংক্ষিপ্ত করতে হল সময়ের অভাবে। হাতিবাগান থেকে শোভাবাজার-জোড়াসাঁকো-মেছুয়ার দিকটায় যাওয়া হল না, সোজা কলেজ স্কোয়ার। কলেজ স্কোয়ারে একদল ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণী গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে ও চা খাইয়ে সাইকেলযাত্রীদের আপ্যায়ন করল সেখানে।
কলেজ স্কোয়ার থেকে মিন্টোপার্ক পৌঁছালে বেশ একটা বড়ো সাইকেল-আরোহীর দল যোগ দিল। মহা উৎসাহে মিছিল চলল এলগিন রোড হয়ে ভবানীপুরের দিকে। ভবানীপুরে যদুবাবুর বাজারের কাছে ‘কলকাতা সাইকেল-আরোহী অধিকার ও জীবিকা রক্ষা কমিটি’র উদ্যোগে আবার একটা সংক্ষিপ্ত পথসভা হল। অল্প কিছুক্ষণের জন্য বড়ো রাস্তায় গাড়ি চলাচল থেমে গিয়েছিল। সাইকেলযাত্রীরা দ্রুত একপাশে সরে গিয়ে গাড়ি চলার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল। তবু কেন বোঝা গেল না, ভবানীপুর থানা ও হাজরার মধ্যিখানে পুলিশের বড়ো একটা দল এসে র‍্যালিটি আটকাল। র‍্যালির উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সারাদিনের এই কলকাতা পরিক্রমার আখ্যান শুনেই কিনা জানি না, শেষে ৫০ মিটার পায়ে হেঁটে সাইকেল-আরোহীরা চলার পর তাদেরকে আবার সাইকেলে উঠতে দেওয়া হল।
পুলিশ আধঘণ্টা সময় নষ্ট করে দেওয়ায়, হাজরা থেকে টালিগঞ্জ ফাঁড়ি পর্যন্ত সাইকেল র‍্যালির গতি একটু বেড়ে গিয়েছিল। সন্ধ্যে ছ-টা নাগাদ তারাতলা মোড়ে ক্লান্ত সাইকেলযাত্রীরা যখন এসে যখন নামল, তখনও তাদের উৎসাহ দেখবার মতো। মোটের ওপর সফল প্রায় ৭০ কিমি দীর্ঘ সাইকেল যাত্রায় কম করে ৬০ জন থেকে ১২০ জন পর্যন্ত সাইকেল-আরোহী সব সময় উপস্থিত ছিল এবং তাদের সহযোগিতা করার জন্য ম্যাটাডোরে কম করে ১০ থেকে ১৫ জন সব সময় হাজির ছিল। মোট অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা দুই শতাধিক। কেউ ঢুকেছে এখানে, তো কেউ বেরিয়েছে ওখানে। সারা কলকাতা জুড়ে চক্রাকারে এত দীর্ঘ সাইকেল র‍্যালির কোনো নজির নেই, যার মূল দাবি ‘অবাধে সাইকেল চালাতে দেওয়া’। এটাই প্রথম অভিজ্ঞতা, এখন অভিজ্ঞতার সারসংকলনের পালা।
র‍্যালিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন সাইকেল সমাজ, যুবভারত, কেসিএএজেআরসি, পিডিএসএফ, ঘুম নেই, কালি কলম ইজেল, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকর্মী, মন্থন, চক্র সত্যাগ্রহ, পারেজিয়া, আমরা-এক সচেতন প্রয়াস, দুর্বার কলম, দামামা, দেশলাই কাঠি, দৃশ্যান্তর, দিশা, স্বয়ংনিযুক্তি প্রভৃতি সংগঠিত উদ্যোগ এবং আরও অনেকে, ব্যক্তিগত বা বন্ধু-বান্ধব মিলে। এছাড়া, নদিয়ার শান্তিপুরের নাট্যকর্মী, হাওড়ার পত্রিকা কর্মী ও উত্তর চব্বিশ পরগনার মানবাধিকার কর্মী কেউ কেউ আগের দিন রাতে এসে বন্ধুদের বাড়িতে থেকে গিয়ে র‍্যালিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন।