- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

পিএফ-এর সঞ্চয়টুকুতেও হাত, চকিতে সংঘবদ্ধ বেঙ্গালুরুর পোশাক শ্রমিকরা, পিছু হটল কেন্দ্র সরকার

শমীক সরকার, কলকাতা, ২০ এপ্রিল#

পিএফ এর সঞ্চয়টুকুতে হাত মানা যায় না, হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক বেঙ্গালুরুর রাস্তায়। ছবি দ্য হিন্দু পত্রিকার ওয়েবসাইট থেকে।
পিএফ এর সঞ্চয়টুকুতে হাত মানা যায় না, হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক বেঙ্গালুরুর রাস্তায়। ছবি দ্য হিন্দু পত্রিকার ওয়েবসাইট থেকে।

কেন্দ্রীয় সরকার ‘এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডস এন্ড মিসেলেনিয়াস প্রভিশন অ্যাক্ট, ১৯৫২’ তে বদল ঘটিয়েছিল। আগে ছিল, কোনো শ্রমিক/কর্মচারীর বয়স চুয়ান্ন হয়ে গেলেই এই ফান্ড থেকে টাকা তুলতে পারবে সে। কিন্তু নতুন সংযোজনীতে বলা হয়, বয়স আটান্ন না হলে তুলতে পারবে না। এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ডে শ্রমিক/কর্মচারীরা টাকা জমায়, একইসাথে সরকার/মালিকের তরফেও একটা অংশ জমা করা হয় (অনেক কারখানাতেই মালিক জমা রাখে না ইচ্ছে করে, বেআইনিভাবে)। নতুন সংযোজনীতে বলা হয়েছিল, শ্রমিকরা কেবল নিজেদের জমানো অংশটাই তুলতে পারবে। এইভাবে প্রভিডেন্ট ফান্ড, যা কি না শ্রমিকের একমাত্র সঞ্চয় ও বিপদ আপদের ভরসা, তার কার্যকরীতা প্রায় তুলে দিতে বসেছিল কেন্দ্রীয় সরকার।

অন্য কোনো বিষয় হলে প্রতিবাদ শুরু হয়ে যেত। এমনকি এবারের বাজেটে যখন প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে টাকা তোলার ওপর কর বসানো হয়েছিল, তখনও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ইপিএফ-এর এই ধারাগুলির সঙ্গে যেহেতু পাতি শ্রমিকদের বিষয়, তাই এই নিয়ে প্রতিবাদ শুরু হয়নি। সব দলের কাছেই এখন শ্রমিকরা আর তেমন কোনো জরুরি বিষয় নয়। কিন্তু বেঙ্গালুরুর ছোটো ছোটো পোশাক কারখানার শ্রমিকরা কারোর জন্য অপেক্ষা করেনি।

পোশাক শ্রমিকদের দু-দিনের জনপ্রতিরোধ

ভদ্দরলোকের দুনিয়াকে হতচকিত করে দিয়ে ১৮ এপ্রিল সোমবার বেঙ্গালুরুর বোম্মানহাল্লি আর মাদ্দুর এলাকার রাস্তাঘাটগুলো অবরোধ শুরু করে দশ হাজার পোশাক শ্রমিক।

শাহি এক্সপোর্ট, কে মোহন এন্ড কোং, এবং জকি লিমিটেড সহ পাঁচটি কারখানার শ্রমিকরা হসুর রোড অবরোধ করে। বোম্মানহাল্লিতে জাজ্জালাগেরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকার শাহি এক্সপোর্টস-এর শ্রমিকরা বেঙ্গালুরু-মাইসোর হাইওয়ে অবরোধ করে। এই কারখানায় শ্রমিকরাই সোমবার সকালে শুরু করেছিল, কোদিচিকানহালিতে জমায়েত করে। কারখানায় কারখানায় শ্রমিক ভাই বেরাদরদের আবেদনে সাড়া দিয়ে একের পর এক কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমে পড়ে। একজন শ্রমিক জানান, তারা কাছেই সিংসান্দ্রার ইপিএফ অফিসে যাবে বলে ভেবেছিল, কিন্তু অতদূর পৌঁছতে পারেনি, হসুর রোড অবধি আসতে পেরেছিল। তাতেই হসুর রোড অবরুদ্ধ হয়ে যায়।
বোম্মানহাল্লি, রামানগরম এবং মাদ্দুর-এর পোশাক শ্রমিকদের পিলে চমকানো কার্যকলাপ দেখে উৎসাহিত হয়ে বেঙ্গালুরুর অন্যান্য এলাকার পোশাক শ্রমিকরাও রাস্তায় নেমে পড়তে চেয়েছিল। কিন্তু ইউনিয়ন নেতারা অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাদের আটকায়। কিন্তু পিন্যা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া, যশবন্তপুর এবং মাইশুরু রোডের বিভিন্ন পোশাক কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় না নামলেও ফ্যাক্টরির মধ্যে কোনো কাজ করেনি।

শ্রমিকদের মেজাজ দেখে ভয় পেয়ে রাস্তাগুলোর আশেপাশের শো-রুম এবং দোকানগুলি শাটার ফেলে দেয়। ৩০০ পুলিশ, আটজন ডেপুটি কমিশনার, এবং ২০ প্ল্যাটুন কেএসআরপি গিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। পুলিশের মূল উদ্বেগ ছিল হাইওয়ে ও বড়ো রাস্তাগুলো যাতে না আটকায়। তার জন্য তারা ব্যারিকেড তৈরি করে। সেই ব্যারিকেড ভেঙে ফেলে শ্রমিকরা। পুলিশের দিকে ঢিল ছোঁড়ে। পুলিশও কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়তে শুরু করে। বেত মারে মহিলাদের।
দ্বিতীয় দিনও টানা আন্দোলন চলতে থাকে এবং আরো ছড়িয়ে পড়ে। রাজাজিনগর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার শ্রমিকরা কর্ড রোডে বড়ো মিছিল বের করে। জালাহাল্লিতে তিনটে বাসে আগুন লাগিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। বেঙ্গালুরু স্টেট ট্রান্সপোর্ট তাদের বাস সার্ভিস বন্ধ করে দেয়। নাগাসান্দ্রা আর যশবন্তপুরের মধ্যে মেট্রো পরিষেবাও বন্ধ রাখা হয়।

অবস্থা বেগতিক দেখে কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে, ইএপিএফ-এর সংযোজনী লাগু হওয়া তিনমাসের জন্য স্থগিত রাখা হচ্ছে।

ইপিএফ আইনের বদলের বিষয়ে বেঙ্গালুরুর গারমেন্টস এন্ড টেক্সটাইলস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের কে আর জয়রাম জানান, নতুন সংযোজনী অনুসারে, যদি প্রভিডেন্ট ফান্ডে জমা পড়া বন্ধ হয়ে যায় বা জমা না পড়ে, তাহলে শ্রমিকরা কেবল তাদের নিজেদের জমানো অংশের ওপর মাত্র তিন বছরের সুদ পাবে। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রে একজন শ্রমিক চাকরি আছে কি না তা বুঝতেই পারে না আটান্ন বছর বয়স অবধি। চল্লিশ বছর বয়স হয়ে গেলে একজন অসংগঠিত শ্রমিকের কাজ পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে যায়।
নেতৃত্বহীন, স্বতস্ফুর্ত, সুনির্দিষ্ট দাবিহীন আন্দোলন

দ্য হিন্দু-র রিপোর্ট একটি রিপোর্ট অনুযায়ী

“এই প্রতিবাদ একেবারে স্বতস্ফুর্ত, নেতৃত্বহীন। এবং দেখা যাচ্ছে, এটা পুলিশকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। সর্বোচ্চ স্তরের পুলিশ অফিসাররা বোম্মানহালি মোড়ে গিয়ে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছেন, এই আন্দোলনের কোনো নির্দিষ্ট দাবিও নেই।”

“বেঙ্গালুরুর পুলিশ কমিশনার এন এস মেঘারিক বলেছেন, ‘আমরা কিছু প্রতিবাদীকে ডেকেডুকে কথা বলার চেষ্টা করি। তাদের দাবিগুলোও বোঝার চেষ্টা করি। কিন্তু কেউ এগিয়ে এল না। ওদের কোনো নেতা নেই। কোনো নির্দিষ্ট দাবিও নেই। শুধু ন্যায়বিচারের চাহিদা আছে। ওদের মধ্যে অনেকেই ইপিএফ স্কিমের সংযোজনী ঠিক কী হয়েছে, সে বিষয়ে ঠিকঠাক জানেও না।'”

গারমেন্টস এন্ড টেক্সটাইল ইউনিয়নের নেতা জয়রাম শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে নানা কথা বললেও কী থেকে এই আন্দোলন ছড়ালো সে বিষয়ে বিন্দু বিসর্গ জানেন না। তিনি বলেন, একটি স্থানীয় কন্নড় দৈনিকে একটা খবর বেরোয় শনিবার, যে এবার থেকে আর শ্রমিকরা তাদের পিএফ অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে পারবে না। এ থেকেই মনে হয় আতঙ্ক ছড়িয়েছে শ্রমিকদের মধ্যে।

উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি মিলিতভাবে ২৬ এপ্রিল প্রতিবাদের দিনক্ষণ ধার্য করেছিল।