- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে আপাতত থমকে হিন্দমোটরের বিশালাকার জলাভূমি ভরাট

সংবাদমন্থন প্রতিবেদন, ৪ জুন#

২০০৯ এর ফাইলচিত্রে হিন্দমোটরের জলাভূমি। ছবি কুণাল ঠাকুরের সৌজন্যে পাওয়া।
২০০৯ এর ফাইলচিত্রে হিন্দমোটরের জলাভূমি। ছবি কুণাল ঠাকুরের সৌজন্যে পাওয়া।

শ্রীরাম হাইটেকের রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের কারণে হিন্দমোটর কারখানা সংলগ্ন বিরাট জলাভূমিটির কোনো অংশ যাতে আর আপাতত বুজিয়ে ফেলা না হয়, সে মর্মে নির্দেশ জারি করেছে হাইকোর্ট। পদ্ধতি না মেনে জলাভূমি বোজানো হচ্ছে সেখানে, এই মর্মে একটি রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এই স্থগিতাদেশ দিয়েছিল মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। একইসঙ্গে রাজ্য সরকার এবং কোম্পানিকে এফিডেবিট পেশ করারও নির্দেশ দিয়েছে দুই সপ্তাহের মধ্যে। গ্রীষ্মের অবকাশের পর হাইকোর্ট খুললে তা নিয়ে শুনানি হওয়ার কথা।

হিন্দমোটর কারখানা সংলগ্ন বিরাট জলাভূমি ভরাট করার চেষ্টা দশ বছর ধরে চলছে। হিন্দমোটর কারখানাটি বিড়লাদের। স্বাধীনতার পরের বছরই সরকারের কাছ থেকে শিল্পপতি বিড়লারা প্রায় ৭০৯ একর জমি বিনা পয়সায় লিজ পেয়েছিল (রায়তিস্বত্ব নয়) কারখানা করার জন্য। অর্থাৎ এই জমি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ল্যান্ড হিসেবে নথিভুক্ত হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যে প্রায় ৩১৪ একর কোনোদিনই ব্যবহার করেনি বিড়লারা। এই শতকের প্রথম থেকেই হিন্দমোটর কারখানা গাড়ি ব্যবসায় পিছিয়ে পড়তে থাকে। কারখানার পুনরুজ্জীবনের জন্য বিড়লারা ওই ৩১৪ একর অন্যভাবে (অর্থাৎ ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রয়োজনে নয়) ব্যবহার করার অনুমতি চায় রাজ্য সরকারের কাছে। ২০০৬ সালে তদানীন্তন বাম সরকার জমিটির চরিত্র পাল্টে করে দেয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড কমার্শিয়াল ল্যান্ড। আর মাত্র ১০.৫ কোটি টাকা নিয়ে বিড়লাদের রায়তিস্বত্ব দিয়ে দেয়।

২০০৯ এর ফাইলচিত্রে হিন্দমোটরের জলাভূমি। ছবি কুণাল ঠাকুরের সৌজন্যে পাওয়া।
২০০৯ এর ফাইলচিত্রে হিন্দমোটরের জলাভূমি। ছবি কুণাল ঠাকুরের সৌজন্যে পাওয়া।

সরকার অবশ্য শর্ত দিয়েছিল, এই জমি বেচে যে টাকা বিড়লারা পাবে (সরকারি হিসেবে ৮৫ কোটি টাকার মতো লাভ হবে) তা দিয়ে কারখানার পুনরুজ্জীবন ও শ্রমিকদের বকেয়া মেটানো হবে।

বিড়লারা জমিটা রিয়েল এস্টেট কোম্পানি শ্রীরাম হাইটেক সিটি লিমিটেড-কে বেচে দেয় ২৯৫ কোটি টাকায়। ওই টাকা অবশ্য তারা আর হিন্দমোটর কারখানায় বিনিয়োগ করেনি। কারখানায় তালা ঝুলিয়ে দেয়।

কতটা জমি জলাভূমি? জলাভূমি বোজানোর বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীদের মতে ৩১৪ একর জমির বেশিরভাগটাই। হাইকোর্টের নির্দেশে জলাভূমি সংক্রান্ত যে হাইপাওয়ার কমিটি তৈরি হয়েছিল, তাদের পর্যবেক্ষণ — প্রায় ১২৫ একর জলাভূমি আছে। এর মধ্যে ২৫ একর ইতিমধ্যেই ভরাট হয়ে গেছে। ভরাট করে ফেলেছে শ্রীরাম হাইটেক।

হুগলি জেলার দক্ষিণ অংশের এই জলাভূমিটির একদিকে বর্ধমান মেন লাইন। অন্যদিকে দিল্লী রোড। বালি-ডানকুনি-বৈদ্যবাটি খাল-চাষার খাল হয়ে গঙ্গার জল এই জলাভূমিতে ঢোকে এবং বেরোয় — জোয়ার ভাটার তালে। পূব পশ্চিম জমির ঢাল দিয়ে রেললাইনের পূব দিকের বসতির জল কালভার্ট পেরিয়ে, এই জলাভূমি পেরিয়ে, চাষার খাল হয়ে বালি-বৈদ্যবাটি খালে পড়ে গঙ্গায় যায়। উত্তরপাড়া ভদ্রকালী কোতরং কোন্নগর নবগ্রাম কানাইপুর বাসাই মাখলা রঘুনাথপুর অঞ্চলের জল বেরোয় এই পথ দিয়ে। বহু ধরনের পাখি, গাছপালা, বন্য ও জলজ প্রাণীর বসতি এই জলাভূমি দক্ষিণ হুগলির প্রাণ স্বরূপ।

২০০৯ এর ফাইলচিত্রে হিন্দমোটরের জলাভূমি। ছবি কুণাল ঠাকুরের সৌজন্যে পাওয়া।
২০০৯ এর ফাইলচিত্রে হিন্দমোটরের জলাভূমি। ছবি কুণাল ঠাকুরের সৌজন্যে পাওয়া।

এই প্রকল্প রূপায়নের জন্য ফের তৎপরতা শুরু হয়েছে। শ্রীরাম হাইটেক দৈনিক কাগজে পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা জানান দিয়ে দিয়েছে। ২০১৫ সালের মার্চ মাসে রাজ্য সরকারি স্তর থেকে শ্রীরামের ছয় হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের প্রথম ফেজ-এর ছাড়পত্র দিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয় ৩০ একর মতো জলাভূমি রয়েছে, সেখানে কোনো নির্মাণকার্য করা যাবে না। অর্থাৎ সরকারেরই হাই পাওয়ার কমিটি যে ১২০-২৫ একর জলাভূমি দেখিয়েছিল ২০১২ সালে (যার মধ্যে ২০-২৫ একর বোজকানো হয়ে গেছে), তাকে সরকারেরই আরেকটি স্তর (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) ২০১৫ সালে দেখালো ৩০ একর জলাভূমি বলে। বাকি সত্তর একর গেল কোথায়?

এমতাবস্থায় পরিবেশ ও সমাজকর্মীদের সংগঠন দিশার করা একটি রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর এবং বিচারপতি অরিজিত ব্যানার্জি জলাজমি ভরাট করার ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহের অর্ডারটিতে বলা হয়েছে, আবেদনকারীদের কৌঁসুলীর মতে, প্রায় ষোলোটি জলাভূমি, যেগুলি পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত, সেগুলো ভরাট করে দেওয়ার কথা কোম্পানিটির, সেটা যেন তারা না করে। রাজ্য সরকার এবং হাই পাওয়ার কমিটিকেও হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, যাতে তারা পদ্ধতি না মেনে জলাভূমি ভরাট করে দেওয়া যাতে না হয় তার জন্য নজরদারি জারি রাখে। প্রকল্পের কিছু কাজ চলতেই পারে, তবে তার ছদ্মবেশে তারা যেন জলাভূমি ভরাট না করে সে বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যও কোম্পানিকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

পরবর্তী শুনানি ৬ জুন হওয়ার কথা।