- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

যশোর রোডের প্রাচীন গাছের ছায়ায় ছায়ায় সত্তর কিমি সাইকেল যাত্রা

সৈকত মিস্ত্রী, হাবড়া, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ছবিগুলো শমীক সরকারের তোলা।#

যশোর রোডে। ১৩ ফেব্রুয়ারি। বঙ্কিম।
যশোর রোডে। ১৩ ফেব্রুয়ারি। বঙ্কিম।

১৩ ফেব্রুয়ারি ৭ টার আশেপাশে।  সরস্বতী পূজার সকাল। হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতাল রোড আর যশোর রোডের সংলগ্ন জায়গায় আমাদের পরস্পরের সঙ্গে দেখা। প্রদুৎ দা সবার আগে এসেছিল। ও বার বার কল করতে থাকে। নির্ধারিত সময়টা ছিল ৭ টা। ষাটোর্ধ স্বপন দা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সাড়ে ছটার মধ্যে পৌঁছালেন। আমরাই দেরি করলাম বেরাতে। বন্ধুদের জন্য সাথে করে সাইকেল নিয়ে যেতে দেরিই হল।

ততক্ষণ কলকাতা থেকে শমীক আর শ্রীমান চলে এসেছে। ঝাড়গ্রাম থেকে যোগ দিয়েছে অমিত। স্থানীয় বলতে আমি বঙ্কিম দা নূপুর স্বপন দা। মহীদূলের আসার জন্য অপেক্ষা করছি। বার কয়েক ফোন করলাম। সবাই অধৈর্য হয়ে উঠেছি। শুরু করার জন্য ছটফটানি বাড়ছে। দেখি হন্তদন্ত হয়ে হাতে আর একটি সাইকেল নিয়ে মহী এল। সাথে নিয়ে জান (জান মহম্মদ ওর ছাত্র), রোদ তখন ও ওঠেনি। পাতলা কুয়াশা। শীত চলে গেছে । বসন্ত প্রায় সমাগত। আমরা দলবেঁধে ক’জনে মিলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যাত্রাপথ সুদূর পেট্রাপোল সীমান্ত। ৩৫ কিলোমিটার পথ। পথ — ঐতিহ্যের যশোর রোড।

যশোর রোড, ১৩ ফেব্রুয়ারি।
যশোর রোড, ১৩ ফেব্রুয়ারি।

এই ভোরে হাবড়ার যানজটের চেনা ছবিটার সামনে পড়লাম। দ্রুত ভিড়কে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেলাম।  থামতে হল হাটথুবা স্কুলের কাছে। যশোর রোডের পাশে একটা বেশ বড় বট গাছ। ঝুড়ি নেমেছে। প্রদ্যুৎ বলল, রাস্তার দু পাশে কুড়ি ফুটের ওপর যে ফাঁকা জায়গা সেখান দিয়ে নিদ্বির্ধায় আরও দুটি লেন বের করা যেতে পারে। তাতে গাছগুলোও বাঁচবে, আবার দোকানগুলোও বাঁচবে। দোকানদারদের অস্তিত্বের স্বার্থ আর গাছ বাঁচানোর স্বার্থ এখানে মিলে যাচ্ছে। এই কথাটা তুলতে হবে। প্রদ্যুৎ একেবারে এই এলাকার ছেলে। বলল, এই গাছটার মত আরও গাছকে মাঝখানে রেখে এঁকে বেঁকে চলে যেতে পারে যশোর রোড।  শমীক ছবি তুলল গাছটার। আবার ও পা দিলাম প্যাডেলে । পর পর সাইকেল চলছে। কখন ও এগিয়ে যাচ্ছি কখনও পিছিয়ে। হাবড়া শহর পার করে রাস্তা এগিয়ে চলছে গ্রামের দিকে। গাছগুলো নিবিড় হচ্ছে। জনবসতি কমে আসছে। গনদীপায়নের কাছাকাছি আসতে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল পম্পা — প্রদুৎ দার দাদার মেয়ে।  ঘুরতে ভালোবাসে।

গাইঘাটার কাছে।
গাইঘাটার কাছে।

গনদীপায়ন ছাড়িয়ে রাস্তা ধরে কুলপুকুরের মধ্যে দিয়ে চলছি। রাস্তার দুপাশে সব প্রকান্ড শিরীষ মেহগনি গাছ। কোথাও আম বট ও আছে। গাছে গাছে অজস্র কোটর। ডালগুলো থেকে ঝুলে আছে সবুজ পরগাছা। কদাচিৎ আমের ডালে বোল এসেছে। পথে ধারে কোথাও কোথাও মরা গাছ। ঠায় দাঁড়ানো। পথের দু পাশে ঝোপঝাড়, ডোবা। বহুবার গাড়ি চেপে এই রাস্তা দিয়ে গেছি। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্য কখনও নজরে আসেনি। রাস্তার দুধারে একসময় লোকালয় প্রায় নেই হয়ে গেল।  তার জায়গায় জেগে উঠল দিগন্ত ছোঁয়া মাঠ।  চাষ হচ্ছে। আবার কোথাও পাকা শস্যে ছেয়ে আছে মাঠ। আবার কল দিয়ে চলছে শস্য মাড়াই।

বীথির মাঝে সাইকেলে আমরা। ১৩ ফেব্রুয়ারি
বীথির মাঝে সাইকেলে আমরা। ১৩ ফেব্রুয়ারি

দু পাশ দিয়ে হুশ হুশ করে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি।  বাইকগুলো বেপরোয়া।  পথের ধারে ধারে ছোট মন্ডপ করে চলেছে সরস্বতীর।  বেলা বাড়ছে । পেটে টান ধরেছে। একটা বাজারের কাছে দাড়াঁলাম। একটা মিষ্টির দোকানে জলযোগ সেরে যাত্রা শুরু হল। ঘড়ির কাঁটা তখন 9:30 এর কাছে। রাস্তা ঘাটে একটি দুটি করে স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের দেখা মিলেছে। ছোট মেয়েরা পড়েছে রকমারি শাড়ি। কেউবা শালোয়ার।  ছেলেদের গায়ে পাঞ্জাবিআ। যত এগোই গাছের সংখ্যা বাড়ে। পথের উপর ডাল পাল ছড়িয়ে একটা সামিয়ানা তৈরি হয়েছে যেন। রোদের তাপ বাড়ছে। ঘাম জমছে কপালে।  মহীর ছাত্র জান, এবার মাধ্যমিক দেবে। এই দলে সেই সবথেকে ছোট। ওর বয়সী কেউ নেই।  আমাদের থেমে যাওয়া আর পারস্পরিক সংলাপগুলো ওর একঘেয়ে লাগছিল। আজ ওর বয়সী ছেলে মেয়েরা রঙীন প্রজাপতি হয়ে উঠেছে। এমন দিনে এভাবে কি চলা যায়? শুধু গাছের কথা কি বলা যায়? জান ভাবতে পারে না। মহীকে বলে প্যাডেলে জোরে পা দেয় সে।

জালেশ্বর ব্রীজের উপর আমরা দাঁড়ালাম।  নিচ দিয়ে বয়ে গেছে যমুনা। বর্ষার জলে পুষ্ট। এ সময় জল কমে এসেছে। তার উপর কচুরিপানা আষ্টে পিষ্টে ধরেছে যমুনার প্রবাহ। অদূরে শ্মশান।  প্রদুৎ দা বিদায় নিল। ওকে ডিউটি ধরতে হবে।

রোদের তাপ আর ও বাড়ছে। চাদঁপাড়া বাজারের কাছে থামলাম। প্রকান্ড মেহগনি গাছের গায়ে খাঁশি কাটার দোকান। মনে হল নতুন বানানো। গাছের গা ফুঁড়ে তৈরি হয়েছে ছাউনি বসার পাটাতন। ওখানে বসা গেল তারপর আবার ও চলতে শুরু করি। ওখান থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় একজন যুবক, সুরজিৎ।  কিছুটা গিয়ে সে ও ফিরে যায়।

প্রকাণ্ড গাছগুলো যেন গিলে খেতে আসছে।
প্রকাণ্ড গাছগুলো যেন গিলে খেতে আসছে।

আবার ও থামতে হল কালুপুর বাজার।  এখানে গাছগুলির দৈর্ঘ্য প্রকান্ড।  রাস্তার দুধারে বাজার গড়ে উঠেছে।  হঠাৎই নজরে এল বিশাল মেহগনি গাছের মগডালে একটা দশাশই পাখির বাসা।  বলি শকুনের বাসা হবে।  শমীক কিছু বলার আগেই থামিয়ে দিলেন স্থানীয় এক ভদ্রলোক।   বললেন ওটা বাজ প্রজাতির একটা পাখির বাসা।  বছরে একটি ডিম দেয়।  বলি কতদিন ওরা আছে।  ভদ্রলোক জানালেন আয়লায় ডাল ভেঙে যাওয়ার পর থেকে পাঁচ বছর এখনেই আছে।  শমীক বলে, শোনা যাচ্ছে গাছগুলো কাটা হবে! ভদ্রলোক বললেন, গাছ কাটার কথা শুনেছেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাটা হয়নি। ওনার মনে হয়, সরকার গাছগুলো কাটবে না। কারণ এই গাছগুলোর জন্য এই যশোর রোড দিয়ে কী গাড়িঘোড়া চলছে তা দেখা যায় না, বা স্যালেটাইটে ধরা পড়ে না। বর্ডার এলাকা, যুদ্ধটুদ্ধ হলে এখান দিয়ে আর্মি ট্যাঙ্কার নিয়ে যেতে হবে, শত্রুপক্ষের স্যাটেলাইট এড়িয়ে, নাকি!

ফটোগ্রাফার আর যারা পরে যোগ দিয়েছিল বা আগে ফিরে গেছে, তারা বাদে সকলে।
ফটোগ্রাফার আর যারা পরে যোগ দিয়েছিল বা আগে ফিরে গেছে, তারা বাদে সকলে।

কালুপুর বাজারেই যোগা দেয় রাম দা, রামচন্দ্র পাল।  চা খেতে খেতে বলতে থাকে, গাছ নিয়ে ও ভেবেছে।  ওপাশে প্রতেকটা গাছের কাণ্ড এভাবে ছেদ করে দোকান হয়েছে।  গাছগুলোর সংরক্ষণ দরকার।   অনেকেই তাঁর মতো ভাবলেও কেউ এগিয়ে আসছে না।  একটু সামনে বিলিতি মদের দোকান।  গাছ কেটে দোকানের সামনে টা বাঁধানো।  কিছুটা গিয়ে রাম দা ফিরে যায়।  আজ ওর বাড়ি ফাঁকা।  তাই ওর যাওয়া হলনা।

এরপর থামি বনগাঁ।  ওখানে যোগ দেয় রোহন।  স্থানীয় যুবক।  পথ ঘাট চেনে।  যাচ্ছি পেট্রাপোল।  স্বপন দা জানতে চায় ওখান থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়?  রোহন বলে, না, আরেকটা পয়েন্ট আছে সেখান দিয়ে দেখা যায়।  শেষমেষ পেট্রাপোল যাওয়াই ঠিক হয়।  যশোর রোড এবার উঁচু হয়ে উঠেছে।  সামনে ইছামতীর ব্রীজ।  আমারা ব্রীজে উঠি।  নিচে ইছামতী।  বিস্মর নিস্তরঙ্গ।  কচুরিপানায় ভরা।  এবার সোজা পেট্রাপোল।

এই সেই জায়গা, যেখানে গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা বড়ো করা হয়েছিল।
এই সেই জায়গা, যেখানে গাছ বাঁচিয়ে রাস্তা বড়ো করা হয়েছিল।

পথে পড়ল আর একটা ব্রীজ।  এখানের পরিবেশ আর ও সুন্দর,শান্ত, স্নিগ্ধ,যানজট নেই।  নিচে শুকিয়ে আসা জলের ধারা।  অনেকটা খালের মতো।  দু পাশে ধানের চারা লাগানো হয়েছে।  নাওভাঙা নদী।  আর আজ গতিহারা।

গাড়ির সংখ্যা কমে এসছে।  কিন্তু প্রচন্ড গতিশীল।  বাইকগুলোও বেপরোয়া।  রাস্তার ধার ঘেঁষে আমারা সাইকেল চালাচ্ছি রোদ চড়ছে।  জনবসতি পাতলা হয়ে এসেছে।  হঠাৎই রাস্তাটা দু ভাগ হয়ে গেল।  দুটো রাস্তার দু পাশেই সার বাঁধা গাছ।  গাছ গুলি সতেজ সবুজ।  প্রকৃতি বড্ড শান্ত।  আমরা বাঁ দিকের রাস্তা ধরি।  পথের পাশে ঘন বাঁশবন।  এমাথা ওমাথা সবুজ বাঁশ, গাছের মাথায় টিয়ার ঝাঁক।  শীতল ছায়ায় সর্বঙ্গ জুড়িয়ে আসছে।  বঙ্কিম দা বলে ওঠে এটাই বোধহয় স্বর্গীয় পরিবেশ।

এগোতে থাকি।  অদূরে বাংলাদেশ ।   পেট্রাপোল কাছে পথের ধারে কিছুটা জায়গায় গাছ কম।  কাটা হয়েছে।  খাড়া রোদ এসে পুড়িয়ে দিচ্ছে।  কিছুটা এগোতে বর্ডার সিকিউরিটি বাহিনীর জওয়ানদের দেখা মিলল ।  কাঁধে বন্দুক নিয়ে দাঁড়ানো ।   ওদের পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাই।  রাস্তার দুধারের ছবি বদলে যায়।   আবার ও নিবিড় গাছ।  তাঁর ডালপালা মেলে দিয়েছে।  শীতল ছায়া ।   চেকপোস্টের সামনে এসে জওয়ানদের নির্দেশ মতো থেমে গেলাম।  রোহন বলে, আর এগানো যাবে না।  দুটো দেশের বুকে বিভেদের স্মারক হয়ে দাঁড়ানো একটা স্থাপত্যের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ি।

বর্ডার মানে না বটপী। পড়শি দেশ বাংলাদেশেও যশোর রোড ধরে রয়েছে সেই প্রাচীন গাছ। বেনেপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত।
বর্ডার মানে না বটপী।
পড়শি দেশ বাংলাদেশেও যশোর রোড ধরে রয়েছে সেই প্রাচীন গাছ। বেনেপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত।

জওয়ানদের দিকে ক’জন হেঁটে এগিয়ে গেলাম।  স্বপন দা জিজ্ঞাসা করলেন, সাইকেল নিয়ে ওপারে যাওয়া যায়? কর্তব্যরত জওয়ান জানাল, ভিসা পাসপোর্ট থাকলে যায়।  মন্থর পায়ে এখানে হাঁটি।  একটা বড়ো গাছের দিকে এগিয়ে যায় বঙ্কিম দা।  গাছে বাঁধা একটা পেরেক তুলে নেয়।  জওয়ানরা জানিয়ে দেয় আর থাকা চলবে না।  এবার ফেরার পালা।

ফিরতি পথে রোহন নিয়ে যায় হরপ্পার আবিষ্কর্তা রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়ের এর বাড়ি।  বনেদি বাড়ি, সিংহ দুয়ার, জীর্ণ ঘর।  যেন একালের মহেঞ্জাদড়ো।  পাশে জোড়া মন্দির।  প্রকান্ড বট গাছ ঝুড়ি নেমে এক অপূর্ব স্থাপত্য।   সময় গড়ায়।  ফেরার তারা চাপে।  দীর্ঘ পথ যেতে হবে।  রওনা দিই।  সবটা পিছনে পড়ে থাকে।  একরাশ স্মৃতি আর অন্যরকম আনন্দকে নিয়ে ফিরে আসি।