- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

দক্ষিণ কাশ্মীর ছাড়িয়ে উত্তরেও ছড়িয়েছে বিদ্রোহ, ভয়াবহ দমন সরকারের, মোবাইল-ইন্টারনেটের পর কাশ্মীরি সংবাদপত্র-ও বন্ধ

শমীক সরকার, ১৭ জুলাই#

১৭ জুলাই রবিবার রাইজিং কাশ্মীরের ইপেপার-এর প্তথম পাতা।
১৭ জুলাই রবিবার রাইজিং কাশ্মীরের ইপেপার-এর প্রথম পাতা।

দক্ষিণ কাশ্মীরের যুব-বিদ্রোহ উত্তর কাশ্মীরেও ছড়িয়েছে। মঙ্গলবার ১২ জুলাই উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারার ক্রালাপোরাতে সরকারবিরোধী মিছিল হয়। সেই মিছিল থেকে পুলিশ সিআরপিএফ-এর দিকে পাথর ছোঁড়া হয়। একটি পুলিশের গাড়ি লক্ষ্য করেও পাথর ছোঁড়া হয়। পুলিশ প্রথমে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে, তারপর গুলি ছোঁড়ে। তাতে দু-জন প্রতিবাদী যুবক মারা যায়, বারোজন আহত হয়। অন্যদিকে পুলিশের এক মুখপাত্র ঘটনার অন্যরকম বিবরণ দেয় — কিছু লোক ক্রালাপোরার থানা আক্রমণ করে, একটা পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, যার মধ্যে পুলিশরা ছিল। তখন পুলিশ গুলি চালালে একজন মারা যায় — এই হলো পুলিশের মুখপাত্রের বয়ান। উত্তর কাশ্মীরের বারামুল্লাতেও বিক্ষোভ হয়েছে।

১২ জুলাই : “প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শেষকৃত্যকারী শহীদের শেষকৃত্য করবে না”
১১ জুলাই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ সইদ-এর এলাকা বিজবেহারায় পুলিশ গুলি চালালে তিনজন যুবক আহত হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমি নাজির লাট্টু ১২ জুলাই মারা যায় হাসপাতালে। মৃতদেহ নিয়ে বিশাল মিছিল হয়। মিছিলে ভারত-বিরোধী এবং ‘আজাদি’-র স্লোগান ওঠে। তার শেষকৃত্যে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর শেষকৃত্যে অংশ নেওয়া এক স্থানীয় ইমামকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। ক্রুদ্ধ যুবকরা বাধা দিয়ে প্রশ্ন করে, ‘যে মুফতি সঈদের শেষকৃত্য করেছিল, সে কি করে আমাদের প্রিয় শহীদের শেষকৃত্যে অংশ নেবে? সময় এসে গেছে পক্ষ নেবার। একটা রেখা টেনে দেবার।’ শেষকৃত্যের পরে নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে প্রতিবাদী যুবকরা।
১২ জুলাই প্রতিবাদী যুবকদের সঙ্গে নিরাপত্তাবাহিনীর দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে বুলবুল বাঘ, নওগাম, আমিরা কাদাল, নুরবাঘ, ঈদগা, চানপোরা বাইপাস, সাফা কাদাল, করন নগর, ট্যাঙ্কিপোরা, বাটামালু, কামারওয়ারি, শালিমার, হাবাক, হজরতবাল, নওহাট্টা, মাইসুমা ইত্যাদি জায়গায়। শ্রীনগরের বিভিন্ন এলাকায় ‘বুরহান এখনো বেঁচে’ জাতীয় দেওয়াল লিখন দেখা যায়।

১৩ জুলাই : ঝিলামে ভাসল মৃতদেহ
১৩ জুলাই অনন্তনাগে পুলিশের দিকে প্রতিবাদী যুবকেরা পাথর ছুঁড়লে পুলিশ গুলি চালায়, তাতে একজন মারা যায়।
৯ তারিখ বুরহানের শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরোনো যুবক কাকপোরার জহুর আহমেদ মাট্টুর মৃতদেহ ১৩ তারিখ ঝিলাম নদীর জলে ভেসে ওঠে। নিরাপত্তা বাহিনীর ছররা বুলেটের আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়।
দক্ষিণ কাশ্মীরের কুলগাম জেলার কুজ্জর গ্রামে এক প্রাক্তন ঈখওয়ানি (পুলিশের চর) র বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় মানুষ।
১৩ তারিখ সবচেয়ে বড়ো সংঘর্ষ হয় কোকেরনাগ-এ। তারপর সিআরপিএফ জওয়ানরা বাড়ি বাড়ি দরজা ভেঙে ঢুকে বাসিন্দাদের মারধোর করে ও গৃহসামগ্রী ভাঙচুর চালায়। মধ্য কাশ্মীরের বুদগামেও সিআরপিএফ বাহিনী সন্ধ্যেবেলা বাড়ি বাড়ি ঢুকে ঢুকে হামলা চালায় বলে অভিযোগ জানায় বাসিন্দারা। বান্দিপোরায় দু-জন যুবক সিআরপিএফ এর তাড়া খেয়ে ঝিলাম নদীতে পড়ে যায় বলে খবর পাওয়া যায়।
১৩ জুলাই প্রতিবাদী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয় খুদওয়ানি, পুটকা সোপোর, কুলগাম, ইমান সাহিব, শোপিয়ান, কাকপোরা, ক্রালপোরা, কুপওয়ারা, ত্রেহগাম, লাঙ্গাত, লালপোরা এবং পাট্টান, পালহালান, বান্দিপোরা, ওয়ারপোরা, বারামুল্লা ও শ্রীনগরের বিভিন্ন জায়গায়।
পুলিশ যূত্রে জানা যায়, জঙ্গীরা ইমান সাহিব-এ মালিক গুন্দ-এর কাছে জাইনাপোরা এসডিপিও-র গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে। যদিও কেউ হতাহত হয়নি।

১৪ জুলাই : ষোলো বছরের ইরফান মৃত, লালচক-এ পরীক্ষামূলক দ্রোণ মহড়া

১৪ জুলাই কোকেরনাগের বুমদোরায় যে বাড়িতে বুরহানি ওয়ানি নিহত হয়েছিল, সেই বাড়িটা আগুন জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের মানুষ। একটা গুজব ছড়িয়েছিল তার আগে যে ওই বাড়ির লোকেরা বুরহানকে ধরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে জড়িত।
কুলগাম জেলার ষোলো বছরের ইরফান আহমেদ দার এই দিন মারা যায়। পরিবার সূত্রে জানা যায়, সে কয়েকদিন আগে তাদের পারিবারিক মশলা দোকানে বসে দোকান সামলাচ্ছিল। একদল প্রতিবাদীকে তাড়া করে এসে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের না পেয়ে ইরফানকে ধরে মারতে মারতে নিয়ে চলে যায়। তারপর তাকে আধমরা অবস্থায় সৌরার স্কিমস হাসপাতালের গেটের সামনে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল। স্কিমস হাসপাতালের এক ডাক্তার সূত্রে জানা যায়, ইরফানের ট্রাকিয়া ছিন্ন করা হয়েছিল, সেখানে একটা নল ঢুকিয়ে ফুসফুসে অক্সিজেন চলাচলের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। তার মাথাতেও আঘাত লেগেছিল এবং ব্রেনে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার বাঁচার সম্ভবনা খুব ক্ষীণ ছিল।
১৪ জুলাই হালকা সংঘর্ষ হয় কাইমো, কুলগাম, খুদওয়ানি, ত্রেগাম, লালপোরা, বাতেরগ্রাম, কুপওয়ারা, হিহামা, হাতমুল্লা, ওয়ারপোরা, সোপোর, আরামপোরা, সিমেন্ট ব্রিজ, বারামুল্লা, পালহালান, সুজাইথ, পারিমপোরা, নারবাল, চিঙ্ক্রাল মোহাল্লা, এবং হাবাকাদাল-এ।
এদিকে টানা কার্ফুর জন্য বাচ্চাদের খাবার, ওষুধ এবং অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব দেখা দেয় কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায়।
বিচ্ছিন্নতাকামীরা একটি র‍্যালির পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু গিলানি ও মিরওয়াইজকে গ্রেফতার করে পুলিশ, ১৩ জুলাই। কিন্তু পরে তাদের আবার তাদের বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখে।
পুলিশ এদিন শ্রীনগরের কেন্দ্রে লাল চক এলাকায় একটি দ্রোন-এর পরীক্ষামূলক মহড়া চালায়।
শুক্রবার জুম্মাবার এগিয়ে আসছে দেখে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে কাশ্মীর জুড়ে সমস্ত ধরনের মোবাইল নেটওয়র্ক বন্ধ করে দেয় সরকার (বিএসএনএল-এর পোস্টপেইড ও ব্রডব্যান্ড ছাড়া)। ব্রডব্যান্ড, ইন্টারনেট তো আগে থেকে বন্ধ ছিল। ট্রেন চলাচলও বন্ধ ছিল। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি বাড়িয়ে সোমবার ১৮ জুলাই অবধি করা হয়েছিল। সমস্ত পরীক্ষা স্থগিত করে দেওয়া হয়েছিল। বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছিল। ৯ জুলাই থেকে কাশ্মীরের বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে কার্ফু জারি তো ছিলই।

১৫ জুলাই : সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ শুরু
১৫ জুলাই শুক্রবার কুপওয়ারা এবং কুলগাম জেলায় নিরাপত্তাবাহিনী গুলি চালিয়ে আরও দুই যুবককে মেরে ফেলে। কুপওয়ারাতে লোলাবের টাঙ্গিবাল-এ বিকেলে সেনাবাহিনী গুলি চালিয়ে একজনকে মারে, নাম মুস্তাক আহমেদ গানাই। অন্যদিকে কুলগামের ইয়ারিপোরাতে সন্ধ্যেবেলা ভারত-বিরোধী স্লোগান দিতে থাকা যুবকদের সাথে পাথর সংঘর্ষের সময় পুলিশ গুলি চালালে একজনের মৃত্যু হয়, তিনজন আহত।
এইদিন একটি হিসেবে জানা যায়, প্রায় ষোলোশ আহতর মধ্যে অন্তত ১২০ জনের চোখে ছড়রা বন্দুকের গুলি বা পেলেট লেগেছে।
এদিন শ্রীনগরের ঐতিহ্যবাহী জামিয়া মসজিদ, দস্তগীর সাহিব দরগাসহ বহু দরগা ও মসজিদে জুম্মাবারের নামাজ নিরাপত্তার কারণে হতে দেয়নি নিরাপত্তাবাহিনী।
এদিন থেকে সাংবাদিকদের ওপর কড়াকড়ি শুরু করে নিরাপত্তা বাহিনী। শ্রীনগরের লাল চক এলাকায় সংবাদপত্র বিক্রেতাদের কাছ থেকে কাগজের কপি কেড়ে নেয় তারা।
সোপোরের মূল চক-এ জুম্মার নামাজের পর পুলিশের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। বারামুল্লার দেলিনায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দু-জন আহত হয়। পাট্টানের খিতেঙ্গন-এ দুই ভাই হিলাল লোন এবং সাজাদ লোন নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে।
বেশিরভাগ এলাকাতেই তারের ব্যারিকেডের কারণে মানুষ গৃহবন্দী থেকেছে আজ। সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ১৭ জুলাই রবিবার অবধি বনধ-এর সময়সীমা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতদসত্ত্বেও বারামুল্লা, পাপচান বন্দীপোরা, সৌরা, রেইনাওয়ারি, ফতে কাদাল, জিবান ইত্যাদি জায়গায় প্রতিবাদী যুবকদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। পারিমপোরাতে একটি পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় বিক্ষুদ্ধরা।
এদিকে এইদিন বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, দিল্লি থেকে নটি চার্টার প্লেন-এ আরও নিরাপত্তা বাহিনী দিল্লি থেকে শ্রীনগরে পদার্পন করেছে। প্রতিটি প্লেন-এ ১৮০ জন করে প্যারামিলিটারি জওয়ান রয়েছে।
শনিবারও অনন্তনাগ, পুলওয়ামা, এবং বারামুল্লায় কার্ফু জারি থাকার ঘোষণা করে দেয় কর্তৃপক্ষ।

১৬ জুলাই : সংবাদপত্র নিষিদ্ধ কাশ্মীরে
১৬ জুলাই শনিবার উত্তর কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলায় একজন যুবকের মৃত্যু হয় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে। হাটমুল্লার পুলিশ চৌকিতে বিক্ষুদ্ধ জনতা আক্রমণ চালালে পুলিশের গুলিতে যুবক সওকত মালিক মারা যায়, আরো দুজন আহত হয়।
একটি সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাতে পুলওয়ামা জেলায় জঙ্গীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে পুলিশ-ছেড়ে-জঙ্গীদলে নাম লেখানো ও পরে আত্মসমর্পন করা সাবির আহমেদ পণ্ডিত এবং মনজুর আহমেদ।
শুক্রবার রাত থেকে গ্রেটার কাশ্মীর সহ বেশ কয়েকটি ইংরেজি ও ঊর্দু সংবাদপত্র অফিসে রেইড করে নিরাপত্তাবাহিনী। শনিবার ভোরবেলার মধ্যে সমস্ত সংবাদপত্র প্রকশনার অফিসে ঢুকে কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। যে কাগজগুলো প্রিন্ট হয়ে গিয়েছিল, সব কপি বাজেয়াপ্ত করে নিরাপত্তাবাহিনী। শনিবার এবং রবিবার কোনো কাগজ বেরোতে পারেনি কাশ্মীরে। তাছাড়া বিএসএনএল ব্রডব্যান্ড ও পোস্টপেইড বিএসএনএল কানেকশন ছাড়া সমস্ত ধরনের মোবাইল, ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে খবরাখবর পাওয়া ও সেগুলি ঠিক কিনা তা যাচাই করাও অসম্ভব হয়ে যাচ্ছিল সংবাদপত্রগুলির কাছে।
২০ জুলাই পাকিস্তান সরকার ‘কাশ্মীরে ভারত সরকারের বর্বরতার বিরুদ্ধে’ পাকিস্তানে কালা দিবস পালনের ডাক দিয়েছে।
শনিবার অবধি আটদিনে কাশ্মীরে ৪৪ জনের মৃত্যু হয়েছে, দু-তিনজন বাদে সবাই নিরাপত্তাবাহিনীর গুলিতে। ১৬০০-র বেশি আহত। ১২০ জনের চোখে ছররা গুলি লেগেছে।