- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

সুমি……… একটি মেয়ের নাম

শীলা ঘটক, কোচবিহার, মে ২০১৬#

শীলা ঘটক এবং সুমি দাস
লেখিকার সাথে সুমি দাস, সাথে মৈত্রীসংযোগ সোসাইটি থেকে প্রকাশিত পত্রিকা- মৈত্রীবার্তা, ফটোঃ সুমি দাসের ফেসবুক পেজ থেকে

বাইরে বেল বাজার শব্দ
ভেতরে আসুন_____
(কাঁধে ব্যাগ, জিনস আর সাদা টপ পরা এক আগন্তুকের প্রবেশ)।
একটু দরকার আছে আপনার সঙ্গে,
বলুন____
আমার একটা ঘরের দরকার।
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আগন্তুকের দিকে……
কি দেখছেন?
না মানে…… আপনার পরিবারে কে কে আছে?
কেউ না আমি একা…… আমি বাড়ী ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন আগে। বলতে পারেন বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসেছি।
ভদ্রলোক চেয়ারটি এগিয়ে দেয়……
আপনার নাম কি?
আমার? আমার নাম সুমি দাস। একসময় সবাই আমাকে অরিন্দম বলে ডাকতো ।
অরিন্দম?
হ্যাঁ, অরিন্দম দাস।
ঠিক আছে আপনি কাল আসুন কথা হবে, ঘুঘুমারী তে আমার একটা বাড়ী আছে, দেখি কি করা যায়।

সুমি চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে।

 

নানা চিন্তা ভিড় করতে থাকে সুমির মনে। সমস্যার শেষ নেই_____ কোন বাড়িওলা বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না আমাদের! সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে রাস্তা পার হয়ে গেল। পেছন থেকে একটা ছেলে সিটি দেয়, সুমি পিছন ফিরে তাকাতেই ছেলেটি চোখের ইশারায় কুৎসিত ইঙ্গিত করে। না দেখি না দেখি করে সুমি তাড়াতাড়ি হাঁটতে থাকে।

শরীরটা আজ বিশেষ ভাল নয় ____ এক পা এক পা করে সুমি তার বর্তমান ঠিকানায় ফিরে আসে। তালা খোলার আওয়াজ পেয়ে বাড়ির মালিক বারান্দা থেকে ঝুঁকে দেখে____ সুমির সঙ্গে চোখাচোখি হয়……

কি ঘর খুঁজে পেলে?

আমায় কিছু বললেন? কিছুটা বিরক্তির সঙ্গে সুমি উত্তর দিল।

বলি ঘর পেলে? বুড়ো বাড়িওলা একটু ঝাঁঝিয়ে প্রশ্ন করে।

মনের কথা গোপন রেখে সুমি বলে না মেসোমশাই এখনও পাইনি, পেলে আপনাকে জানাবো।

কিন্তু সুমি, এমাসের মধ্যেই ছাড়তে হবে কিন্তু, পাড়ার ক্লাব থেকে এসে শাসিয়ে গেছে। বলেছে, সব হিজড়ে- ফিজড়ে রাখা চলবে না।  ওসব পাড়ায় থাকলে পাড়া নষ্ট। দেখো, আমাকে তো পাড়াতে বাস করতে হবে।আমার তো নিজের বাড়ি, আমি আমার বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাব ?

মেসোমশাই, শুধুমাত্র হিজড়েরাই পাড়া নষ্ট করে? তথাকথিত ছেলে বা মেয়েরা বুঝি পাড়া নষ্ট করে না?

অতো কথার দরকার কি বাপু!  তুমি মানে মানে আমার ঘর ছাড়তো _____

সময়মত নখ দাঁত বের করে বাড়িওলা সুমিকে শাসায়।

দরজা খুলে পাখাটা চালিয়ে দিয়ে সুমি বিছানায় শুয়ে পড়ে। ভাবতে থাকে মা-বাবার কথা। ভাবতে ভাবতে তলিয়ে যায় অতীতে ……

সুমির যখন সাত বছর বয়স, সুমির মা মারা গেলেন। বাবা আবার বিয়ে করে নতুন মা নিয়ে এসে হাজির করলো।  ছোটবেলা থেকেই সুমি একটু মেয়েলি ধরণের। শরীরটা ছেলেদের মতো হলেও মনে বাস করে এক নারীসত্তা। পাড়ায় ক্রিকেট খেলা, বল খেলা এসব সুমি পছন্দ করতো না। ছোটবেলায় মাকে দেখত কপালে টিপ পরতে …… সুমিও কপালে টিপ ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাতে ভালবাসত।  নতুন মায়ের উস্কানিতে বাবাও ক্রমশ বদলে যেতে শুরু করলো।  ছোটবেলা থেকেই সুমি স্নান করতো গায়ে গামছা চাপা দিয়ে…… এসব দেখে ওর নতুন মা খুব মারধোর করতো।

ছোট থেকে যেহেতু ছেলে হয়েও মেয়েদের মতো_____ এরজন্য স্কুলেও সে প্রিয় ছাত্র ছিল না। পড়াশোনায় খারাপ ছিল না।  যেহেতু ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে সুমি মিশতে পছন্দ করতো না তাই মেয়েবন্ধু ওর বেশী ছিল। টিফিনের সময় ছেলেদের সঙ্গে না খেলে সুমি মেয়েবন্ধুদের সঙ্গে ক্লাসরুমে গল্প করতো, কখনো সখনো মেয়েদের সঙ্গে মাঠে ছি- বুড়ি খেলত। এই মেয়েলিপনার জন্য সুমি কোনদিন শিক্ষকদের কাছে প্রিয়ছাত্র হয়ে উঠতে পারেনি। দিদিমনি, মাস্টারমশাই ____ সবাই ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত।ক্লাস ফাইভ থেকে টেন এই সময়টা ওকে খুব নির্মম অপমান সইতে হয়েছে। কিন্তু সবটাই মানুষের জীবনে খারাপ লাগা হতে পারে না। অনেক খারাপের মধ্যেও ভাললাগা কিছু থাকে…… কিছু ভালো মানুষ থাকেন বলেই হয়ত মানুষ বেঁচে থাকার রসদ পায়। মঞ্জু দিদিমনি আর বনশ্রী দিদিমনি দুজনে সুমি কে খুব স্নেহ করতেন। একদিন একটি ছেলে সুমিকে ‘লেডিস’ বলেছিল। সাথে সাথে ওই দিদিমনি ওই ছেলেটিকে এবং সুমিকে ডেকে নিয়ে ব্ল্যাক বোর্ডের সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিল, অরিন্দম লেডিস তুই জানলি কি করে? অরিন্দম কি তোকে প্যান্ট খুলে দেখিয়েছে যে ও মেয়ে না ছেলে?তুই আগে সবার সামনে দেখা তুই ছেলে না মেয়ে তারপর অরিন্দম দেখাবে ও ছেলে না মেয়ে……… সেই দিনের পর থেকে ছেলেটি অরিন্দম(সুমি) কে আর কোনদিন বিরক্ত করেনি। যতদিন অরিন্দম ওই স্কুলে ছিল ওই দুইজন দিদিমনি ওকে আগলে আগলে রাখত। সে প্রায় বারো বছর আগের ঘটনা। অতীতের নানা স্মৃতি সুমির মনে ভিড় করতে থাকে। আজও অনেক মানুষ অনেক কথা বলে, সুমি কখনো প্রতিবাদ করে, কখনো গুমরে মরে।

একদিন সুমি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলো, কখন যে এতগুলো দিন পার হয়ে গেছে সুমি বুঝতেই পারেনি। ক্রমশ বড়ো হয়ে উঠলো ………..

একদিন সুমির বাবা ওকে ডেকে বলল, তোর এখানে থাকা চলবে না তুই আমার একমাত্র ছেলে , মেয়েদের মতো করে থাকতে চাস____ এতে আমার সম্মান হানি হয়।

তাতে কি হয়েছে বাবা ছেলে বা মেয়ে ___ এতে কি আসে যায়! আমি তো কারোর ক্ষতি করিনা।___  সুমি উত্তর দেয়।

লাভক্ষতির কথা নয়…… সমাজে আমার সম্মান নষ্ট হচ্ছে।

অরিন্দম যখন সেভেনে পড়তো তখন ওর এক নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হয়। অরিন্দমের প্রথম ভালোবাসা তাকেই বলা যায়। যদিও ছেলেটি তাকে কোনদিনই ভালবাসেনি। এর পরে  আরও দু/এক জনের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছিল কিন্তু ভালোবাসার কাঙাল সুমি বার বার ঠকতে থাকে।

প্রায় শূন্য হাতে অরিন্দম বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে শিলিগুড়ির এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ওঠে। ওই বন্ধু ‘মানস বাংলা’ নামে এক NGO তে সুমিকে কাজ করার সুযোগ করে দেয়, কাজ করার পাশাপাশি সুমির রোজগার ও হতে থাকে ওই সংস্থা থেকে। এর পর ২০০৯ তে সুমি ‘মৈত্রী সংযোগ সোসাইটি’ নামে এক গোষ্ঠী ভিত্তিক সংগঠন তৈরির উদ্যোগ নেয়।

কোচবিহার মৈত্রী সংযোগ সোসাইটির সাথে কাজ শুরু হোল। এখন ও একজন রোজগেরে মানুষ। সুমি কে নয় সুমি টাকাকে ভালোবেসে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ সুমি পাশে ঘুর ঘুর করতে থাকে।

বিছানা ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে সুমি রান্নাঘরে গেল। গ্যাসে ভাত বসিয়ে সবজি কেটে রান্নার জোগাড় শুরু করে।

পরদিন সকালে সুমি সেই ভদ্রলোকের বাড়ি যায়…… একটা ঘরের জন্য কাল এসেছিলাম, যদি ভাড়া দেন তো খুব ভাল হয়।

হ্যাঁ দেব, ঘুঘুমারীর বাড়িতে ঘর আছে, ওখানে আমরা থাকি না ওটাই ভাড়া দেব ভাবছি।

দুজনে রওনা হয় ঘুঘুমারীর দিকে, পথে যেতে যেতে অরিন্দম থেকে সুমি হয়ে ওঠার কিছু ঘটনা সুমি, ভদ্রলোককে বলতে থাকে……

পরের দিন সকালে আগের বাড়িওলার কাছে জানালো যে বাড়ি পেয়ে গেছে। সামনের মাসের পয়লা তারিখে সুমি মালপত্র নিয়ে ভাড়া উঠে গেল।

একতলা বাড়ির দরজার বাইরে একটা গ্রিলের গেট। গেট পেড়িয়ে সুমির ঘর। শহর থেকে একটু দূরে। এলাকা টা একটু নিরিবিলি, তাও একটু স্বস্তি পাওয়া গেল।

মৈত্রী সংযোগের বিভিন্ন কাজকর্ম নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকতে হয় সুমিকে। এছাড়া বিভিন্ন সেমিনারে যোগ দিতে কোলকাতা, শিলিগুড়ি বা বিভিন্ন জায়গাতে যেতে হয়। একা একা থাকা যে কি নিদারুন কষ্ট সুমি সেটা সবসময় উপলব্ধি করে! তাও কিছুটা স্বস্তি যে থাকার জন্য একটা ঘর পাওয়া গেছে………

কিন্তু ঝঞ্ঝাট সুমির পিছু ছাড়ে না। কিছুদিন যাবৎ কিছু ছেলে রাত গভীর হলেই গ্রীলে ধাক্কা মারে। দরজায় ঢিল ছোড়ে, জানলায় টোকা দেয়। ভয়ে সুমির ঘুম ভেঙে যায়। কি করবে কিছু ভেবে পায়না …… নানারকম উৎপাত উপদ্রবের মধ্য দিয়ে দিন পার হয়।

একদিন খুব ঝামেলা শুরু হোল…… এই নিয়ে পাশের বাড়ির বাসিন্দা জনসমক্ষে নালিশ জানালো যে সুমি নাকি রাত হলেই ছেলেদের ডাকে…… এক্কেবারে উলোট পুরান। স্বাভাবিভাবে এই ঘরও সুমিকে ছাড়তে হোল।

বর্তমানে সুমির ঠিকানা ঘুঘুমারী বাজারের ভেতর মৈত্রী সংযোগ সোসাইটির অফিসঘর।

জানিনা কবে আমরা মানবিক হবো !!!!!