- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

মেগা ট্যুরিজম ইন্ডাস্ট্রি, অসংখ্য জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র আর পাহাড়ের প্রতি দরদের অভাবে উত্তরাখণ্ড বিপর্যস্ত

সোমনাথ চৌধুরি, রামজীবন ভৌমিক, কোচবিহার, ২৯ জুন#

তিলক সোনির ফেসবুক পেজ এ পাওয়া ছবিতে উত্তরাখণ্ডের এক ১০০ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা বর্ণনা করছেন, তাঁর জীবৎকালে এতবড়ো প্লাবন দেখেননি।
তিলক সোনির ফেসবুক পেজ এ পাওয়া ছবিতে উত্তরাখণ্ডের ওঙ্গি গ্রামের এক ১০০ বছর বয়স্কা বৃদ্ধা বর্ণনা করছেন, তাঁর জীবৎকালে এতবড়ো প্লাবন দেখেননি।

উত্তরাখণ্ডের ভয়াবহ বন্যা ও ধসে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ক্রমেই বেড়ে চলেছে। উত্তরাখণ্ড ও হিমাচলপ্রদেশ এই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সন্মুখীন। অতিবর্ষণে যা ক্ষতি হবার তা তো হয়েইছে। সাথে হিমালয় পর্বতমালার ভঙ্গুর প্রকৃতি ও ভূমির ধারণক্ষমতা কম হওয়ায় খুব দ্রুত ধস নেমেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে কিছু মনুষ্য সৃষ্ট কারণ। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিপুল বৃদ্ধির সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্যে রাস্তার নির্মাণ, প্রচুর পরিমাণ পর্যটকদের আকর্ষণ করার  জন্যে হোটেল, ধর্মশালার সংখ্যার লাগামছাড়া বৃদ্ধি।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক শ্রী মহারাজ পণ্ডিতের মতে ‘হিমালয়ের বহন ক্ষমতার উপর বিশেষ সমীক্ষা চালিয়ে সেই তথ্যের ভিত্তিতে সেই অঞ্চলের উন্নয়নের পরিকল্পনা করা উচিত।’ তিনি এই প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘হিমালয়ের মতো নব্যগঠিত পর্বতশ্রেণী ঠিকঠাকই থাকবে, যদি খুব বেশি অত্যাচার না করা হয়। কিন্তু তীর্থস্থানে যাবার রাস্তার অপরিমিত বিস্তার ও সাথে পরিবহন শিল্পের ব্যাপ্তি উত্তরাখণ্ডের পাহাড়কে একবারে ধসিয়ে দিয়েছে। অধ্যাপক উত্তরাখণ্ডে একটি প্রজেক্টে কাজ করার সময়ে লক্ষ্য করেন, ৭-৮ মিনিটের মধ্যে প্রায় ১১৭টি বাস ওঁর সামনে দিয়ে গেল। উত্তরাখণ্ডের পরিবহন দপ্তর এই ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, ২০০৫-২০০৬ সালে মোট নথিভুক্ত গাড়ির সংখ্যা ছিল ৮৩,০০০ যা ২০১২-২০১৩ তে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৮০,০০০। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছোটোগাড়ি জীপ, ট্যাক্সি — যা পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। যেখানে ২০০৫-২০০৬ সালে নথিভুক্ত হওয়া ছোটো গাড়ির সংখ্যা ছিল ৪,০০০ সেই সংখ্যা ২০১৩ সালে ৪০,০০০ ছাড়িয়েছে।
গঙ্গা তার উচ্চগতিতে ইঞ্জিনিয়ারদের লীলার জায়গা হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলিতভাবে উত্তরাখণ্ড পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্তৃপক্ষ গঙ্গা ও তার বিভিন্ন উপনদী থেকে প্রায় ৯০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে এখনও পর্যন্ত ৭০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করেছে। আর উত্তরাখণ্ডের ১৪টি উপত্যকায় আরও ২২০টি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে খননের কাজ চলছে। এর জন্যে যে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় তাতেই ধসের সম্ভাবনা আরও বেড়ে যাচ্ছে। এই নির্মাণ কাজের জন্যে নদীগুলির গতিপথেরও পরিবর্তন করা হবে, কোথাও সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে আবার কোথাও জলাধারের মধ্যে দিয়ে নদীগুলিকে নিয়ে যাওয়া হবে। এইভাবে ভাগীরথী নদীর প্রায় ৮০\% আর অলকানন্দা নদীর প্রায় ৬৫\% ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাকিরাও একই ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ২০১১-২০১২ সালে অসিগঙ্গায় যে বিপর্যয় হয় (হড়পা বানে প্রায় ৭০ জনের প্রাণহানি) তার জন্যে অসিগঙ্গার জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকেই দায়ী করা হয়। বাঁধ তৈরির জন্যে নিয়মিত কৃত্রিম বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছিল, বিস্ফোরণে পাহাড় থেকে ভেঙে পাথরের টুকরো জমা হচ্ছিল নদীতে। সেগুলো পরিষ্কার না হওয়ায় নদীতে জলস্তর বাড়তে থাকে। এরপর ভারী বৃষ্টি হলে হড়পা বানের সম্ভাবনা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এবারের বিপর্যয়ে উত্তরাখণ্ডে ১২০০ জায়গায় রাস্তা ও ১৪৮টি সেতু ভেঙ্গে পড়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সেচ দপ্তর জানিয়েছে, গত ৩৫ বছরে দিল্লিতে যমুনা নদীর জলস্তর এত বাড়তে আগে কখনও দেখা যায়নি।
স্নাতকস্তরের ছাত্র হরিষ রাওয়াত ২০১০ সালে ভাটওয়ারি অঞ্চলের বড়ো ধসে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পাহাড় কখনোই এত ভঙ্গুর ছিল না। কিন্তু উচ্চক্ষমতা যুক্ত যন্ত্রগুলি সেটাকে দুর্বল করে দিয়েছে। আমরা এখন প্রায়ই ভূমিধসে বিপদের মধ্যে পড়ি।’ হরিষবাবুর বাড়ি ভূমিধসে শেষ হয়ে গিয়েছে। মূল বাজারের ২৪টি দোকান সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন এবং লাগোয়া ২৫টি বাড়িও পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। উত্তরকাশীর বাসিন্দা পেশায় গাড়িচালক শ্রী রামপ্রসাদ তোমার বলেন, ‘পাহাড় কেটে ক্রমাগত রাস্তা বানিয়ে বানিয়ে পাহাড়কে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। রাস্তা বানানোর দায়িত্বে যারা আছে, তারা কেউই এই অঞ্চলের অধিবাসী নয়, কাজেই পাহাড়কে তারা বুঝবে কীভাবে? বেশিরভাগ এক্সপ্রেসওয়ে আইনি জটিলতায় আটকে আছে।’
পরিবেশবিদরা এই ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির জন্যে উন্নয়নের কয়েকটি বৈশিষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে, প্রয়োজনের থেকে বেশি খনন কার্য, সাথে নিয়মিত পাহাড়ে কৃত্রিম বিস্ফোরণ ঘটান রাস্তা তৈরির জন্যে। হোটেল ধর্মশালা রিসর্ট তৈরি করার জন্যে পাহাড় কেটে সমতল জায়গা তৈরি ইত্যাদি। উন্নয়ন বলতে যে ধারণাটা আমাদের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়েছে যে, কোনো অঞ্চলের উন্নয়ন মানেই সেই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর তার জন্যে যতরকমভাবে সম্ভব প্রকৃতিকে শোষণ করা হবে আর প্রকৃতিও সেই শোষণ সহ্য করে যাবে। এই পদ্ধতিতে যে একই সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিবেশের উন্নয়ন সম্ভব না, সেটা পরিষ্কার।
মেঘভাঙা বৃষ্টির ঘটনা এদেশে নতুন নয়, কিন্তু এত ঘন ঘন হবার কারণ পরিবেশের স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হওয়া। মেঘ ভাঙা বৃষ্টির মূল কারণ হল সমন্বিত মেঘেদের বৃষ্টিপাত। ওই অঞ্চলে খুব দ্রুত মেঘের সৃষ্টি হয়। খুব স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মাটি উত্তপ্ত হয়ে জল বাষ্পীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। নতুন করে মেঘ সৃষ্টি হবার জন্যে যতটা সময়ের ব্যবধান প্রয়োজন এখানে তার অবকাশ পাওয়া যায় না। একই সঙ্গে বৃষ্টিপাতের পুরো চক্রটা সম্পূর্ণ হওয়ার সময় দীর্ঘায়িত হওয়ায়, জমা মেঘের পরিমাণ স্বাভাবিকের থেকে কয়েকগুণ বেশি থাকায় মেঘ ভাঙা বৃষ্টির ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে নদীগুলিকে ঘিরে ফেলা হচ্ছে, নদী উপত্যকা ধরে গজিয়ে ওঠা হোটেল ধর্মশালা রিসর্ট ইত্যাদির জন্যে বর্ষার সময়ের নদীতে হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া জল কোথা দিয়ে বের করে দেওয়া যাবে, সেই ব্যাপারে কোনো গঠনগত পরিকল্পনা নেই।
তবে এসব কথা পরিবেশ সচেতন মানুষরা বললেও সরকারের ভ্রূক্ষেপ নেই। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমার রাজ্যের লোক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কারণ পর্যটন মার খাচ্ছে। আমাদের পর্যটনকে আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে।’ কোনো একটি পাহাড়ি অঞ্চলের পর্যটক ধারণ করার একটা ক্ষমতা থাকে। গত বছরের তুলনায় কেদানাথেই পর্যটকের সংখ্যা ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবার। ওই দুর্যোগের সময়ে শুধু কেদারনাথেই ছিলেন এক লক্ষের কাছাকাছি তীর্থযাত্রী। সরকার পর্যটক আকর্ষণ করতে যতটা আগ্রহী, সেই পর্যটকদের নিরাপত্তা সম্পর্কে ততটাই বেখেয়াল। অথচ এই বিপুল লাভের কত শতাংশের অংশীদার উত্তরাখণ্ডের অধিবাসীরা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। \par
গড়ে ওঠা রিসর্ট, ধর্মশালাগুলির বেশিরভাগেরই মালিক দিল্লি, মুম্বই, পঞ্জাব, গুজরাট প্রভৃতি রাজ্যের বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এমনকী এই অঞ্চলের নথিভুক্ত গাড়িগুলির মালিকানাও সেই ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলি হাতে। উত্তরাখণ্ডের অধিবাসীদের গাড়ির চালক, পর্যটক গাইড বা নিদেনপক্ষে হোটেলগুলিতে কাজ করার থেকে বেশি কিছু করার নেই। কাজেই ওই অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নতি বলতে ভারতের বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলি অর্থনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হল, তা-ই বোঝানো হয়ে থাকে। উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী সেই বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলির সমর্থনেই সাফাই দিয়েছেন, ‘যাঁরা বলছেন মেঘভাঙা বৃষ্টি, ভূমিকম্প, ধস, সুনামি ইত্যাদি মনুষ্যসৃষ্ট, তাঁরা নেহাতই বালখিল্যের মতো কথা বলছেন। শতশত বছর ধরে চলে আসা কেদারনাথের ইতিহাসে এই ধরনের ধ্বংসাত্মক ঘটনার কোনো নজির নেই। হিমালয় অঞ্চলের ৩৭০০০ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে ৩৩০ মিমি বৃষ্টি খুব অল্প সময়ের মধ্যে হয়েছে — যা কারো পক্ষে অনুমান করা সম্ভব ছিল না।’