- সংবাদমন্থন - https://songbadmanthan.com -

বৈধ কোনো নাগরিককে বাবা-মা বানিয়ে স্কুলে ঢুকতে হয় ছিটমহলের শিশুকে

বিকর্ণ,৩১শে ডিসেম্বর#

ছিটমহল নিয়ে অনিরুদ্ধ পালিতের কার্টুন
ছিটমহল নিয়ে অনিরুদ্ধ পালিতের কার্টুন

সম্প্রতি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা আবার নতুন করে আশা জাগিয়েছে ছিটমহলের বাসিন্দাদের মধ্যে। যদিও শেষপর্যন্ত কতদূর কি হবে বা আদৌ হবে কি না, নাকি আগের আলচনাগুলোর মতো আবার বন্ধ হয়ে যাবে তা কেউ জানে না।

ঠিক এই সময়েই তরুণ চিত্রশিল্পী শ্রী অনিরুদ্ধ পালিত দুই দেশের সরকারের এই দোলাচল মনোভাবের বিরূদ্ধে, সবকিছু থেকে বঞ্চিত এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রতিবাদ জানাতে শুরু করেছেন কার্টুনে। তিনি প্রথাগতভাবে কার্টুনিস্ট না হলেও তাঁর সাথে আমার আলাপ সেই কার্টুনের মাধ্যমেই। তখন তিনি একটি স্থানীয় সংবাদপত্র ‘মুক্তলিপি’র জন্যে কার্টুন আঁকতেন। সেখানেই তাঁর কার্টুন প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তারপর সেই কাগজের গণ্ডী ছাড়িয়ে তাঁর কার্টুন চলে আসে ফেসবুকে। কিন্তু অম্বিকেশ মহাপাত্রের সেই কার্টুন কান্ডের পর একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এরপর তিনি চাইছিলেন কিছু অন্যরকম কাজ করতে আর তখনই তাঁর একসময়ের সহপাঠী ও ‘ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি’র ভারতীয় ভূখন্ডের সমন্বয়ক দীপ্তিমান সেনগুপ্তের কথায় একটি কার্টুন করে ফেসবুক-এ পোস্ট করেন – প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদীর স্বচ্ছভারত অভিযানের সাথে ছিটমহলকে মিলিয়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই সেই কার্টুন শেয়ার আর লাইক হতে শুরু করে, শুধু এদেশ থেকে নয়, প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকেও। অনিরুদ্ধ প্রত্যেকদিনই একটা করে কার্টুন পোস্ট করতে থাকেন। অনেকের মত আমিও উদ্‌গ্রীব হয়ে বসে থাকতাম সেই কার্টুনের জন্যে। একটি শিশু জন্মাচ্ছে, মানুষ হিসেবে তার পরিচয় আছে চেহারাগতভাবে, কিন্তু নাগরিক হসেবে তার কোনও পরিচয় নেই, বা ঐ মানুষদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলায় মেতেছে দুই দেশ- এই ধরনের মানবিক ও একইসঙ্গে হাস্যরসাত্মক শিল্প জুড়ে যাচ্ছিল ঐ আন্দোলনের সঙ্গে। তার মধ্যেই দীপ্তিমানবাবুর সঙ্গে তিনি ছিটমহলে যান, কথা বলেন, সময় কাটান সেই ছিটমহলবাসীদের সঙ্গে।

এরপর এক সন্ধ্যায় আমার সাথে কথায় অনিরুদ্ধ জানান, সব দিক দিয়ে ছিটমহলবাসী বঞ্চিত, তাদের জন্যে স্কুল নেই, হাসপাতাল নেই, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই, পালস্‌ পোলিও টিকা নেই, সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারের কোনও ব্যাপার নেই। তবু থেমে থাকেনি শেখা, থেমে থাকে না জীবন, কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে সেটা খুবই অনাকাঙ্খিত। যেহেতু ওই অঞ্চলের মানুষদের খাতা কলমে কোন নাগরিক পরিচয় নেই, তাই তাদের ছেলেমেয়েরা ভারতীয় ভূখণ্ডের নাগরিক কোনও পরিবারকে বাবা-মা হিসেবে পরিচয় দিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। আর তারপর সেই পরিচয়ই বহন করতে হচ্ছে — আজীবন বহনও করতে হবে।

এভাবেই দীর্ঘদিন ধরে তারা পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে স্কুলে, কলেজে এমনকি দূরশিক্ষায় এমএ পর্যন্ত পড়ছে বা পড়া শেষ করে ফেলেছে, এটা জেনেই যে তাদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই। যে কোনও সময়ে সামান্য অভিযোগের ভিত্তিতে তারা ভীষণ সমস্যায় পড়তে পারে। এদিকে যে পরিবারগুলি তাদের পরিচয় দিয়েছে তারাও সমস্যায় পড়তে পারে। ভবিষ্যতে যদি ছিটমহল বিনিময় সম্পন্ন হয়, তখন প্রকৃত বাবা-মা কোনোদিনই তাদেরকে নিজের ছেলেমেয়ে বলে দাবি করতে পারবে না।

অনিরুদ্ধ ও দীপ্তিমানবাবু ঠিক করেন, ছিটমহলের শিশুদের নিয়ে এবারের শিশুদিবস পালন করা হবে। ১৪ নভেম্বর পোয়াতিরকুঠি ছিটমহলে শুরু হল শিশুদিবসে অনুষ্ঠান। শিশুরা অংশ নিল ছবি আঁকা, গান বাজনা, ফুটবল খেলায়। তার সাথে খাওয়া দাওয়া। যেন এক নিঃশব্দ বিপ্লব। সেই অনুষ্ঠান দেখল মাঠের বাইরে বসা সবাই।

শিশুদিবসে ছিটমহলের শিশুদের সাথে অনিরুদ্ধ পালিত

শিশুদিবসে ছিটমহলের শিশুদের সাথে অনিরুদ্ধ পালিত

সেখানেই অনিরুদ্ধ দেখলেন মহিলারা বেশিরভাগই অগোচরে আছেন, যোগদান করতে বা সামনে এসে অনুষ্ঠান দেখার সঙ্কোচ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে চলে এলেও পরের গন্তব্য পাশের গ্রাম মশালডাঙ্গায় তিনি কেবল মহিলাদের সঙ্গেই কথা বলতে মনস্থ করেন। দীপ্তিমানবাবু সেই ব্যবস্থা করলেন। মশালডাঙ্গায় পৌঁছে দেখা গেল, একটি ঘরে সামনে বোরখা পড়া ১৫-২০ জন মহিলা, বা মেয়েও হতে পারে।

অনিরুদ্ধ-র বয়ানে এরপর যা ঘটে, ‘আমি তাদের বলি, আমি জানিনা তোমাদের বয়েস কত, তোমাদের তুমি করেই বলছি, তোমরা কি কর তাও আমি জানিনা। শুধু এটা জানি তোমাদের উন্নতি করতে হবে। ছিটমহল বিনিময় যখন কাছাকাছি আসতে শুরু করবে তখন সব রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এখানে আসতে শুরু করবে। যাদের মধ্যে কেউই এতদিন তোমরা কেমন আছো, সেটা নিয়ে ভাবার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি। তারা তোমাদের ভালোমন্দ যত চিন্তা করবে, তার থেকে ঢের বেশি চিন্তা করবে নিজেদের ফায়দা লোটার। তোমাদের এতদিনের সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে তোমাদেরই। সংস্কার শুরু হোক রান্নাঘর থেকে, তবেই এগোবে। যেখানে মহিলারা পিছিয়ে পরে থাকবে, সেখানে সার্বিক উন্নতি সম্ভব নয়। আমি এখানে ছবি আঁকার শেখানোর ব্যাবস্থা করতে চাই — তোমাদের মধ্যে কে সাহায্য করবে?’

‘বোরখার মধ্যে থেকে উত্তর আসে, ‘আমি করব’।

— ‘তোমার নাম কি?’

— ‘শাবানা’।

— ‘শোন শাবানা, রবিবার সকাল ৭টার মধ্যে তোমাদের এখান থেকে একটা ফোন চাই, যে এই আঁকার ক্লাস শুরু করার ব্যবস্থা হয়েছে। যদি ফোন পাই তবেই আমি এগোব নতুবা নয়’।

‘ফোনটা এসেছিল শনিবার সন্ধ্যেবেলা, শাবানা আঁকার ক্লাস শুরু করে দিয়েছে, নাম দিয়েছে ‘গ্রামীন শিল্প চর্চা কেন্দ্র”, বলছিলেন অনিরুদ্ধ, ‘এবারে আরো এগোতে হবে। এখন খারাপ জিনিসই মানুষের কাছে, বিশেষ করে বাচ্চাদের কাছে বেশি সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। সবকিছু থেকে বাঁচিয়ে এগোতে হবে। একদিন এদের দিনও আসবে, আসতেই হবে’।